শনিবার, ২২ অক্টোবর, ২০১১

ফকির লালন শাহকে ‘বর্তমান’ করে তোলা --ফরহাদ মজহার

বাজার ব্যবস্থায় সবকিছুই পণ্য হয়ে ওঠে,  লালন ব্যতিক্রম কেউ নন। ফলে লালন সাধক ছিলেন বলে তাকে নিয়ে সিডি, ভিডিও বা সিনেমার ব্যবসা হবে না, এই গ্যারাণ্টি দেওয়া কঠিন। তাকে নিয়ে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য হচ্ছে, এটা অস্বীকার করার উপায় নাই। লালন সাঁইজীকে বাজারের বিষয়ে পরিণত করার বিরোধিতা করেন অনেকে। অভিযোগ ওঠে লালন কর্পোরেট বাণিজ্যের বিষয়ে পরিণত হয়ে যাচ্ছেন। আপত্তিকর মনে হয়। আপত্তি ওঠা স্বাভাবিক। ফলে ফকির লালন শাহকে বাজারের দূষণ থেকে বিশুদ্ধ রাখার একটা বাসনা ও চেষ্টা দানা বেঁধে উঠতেই পারে। লালন নিয়ে একটা বাজারি আগ্রহ যেমন তৈরী হয়েছে, ঠিক তেমনি একটা উদ্বিগ্নতাও আছে।
সামনে পহেলা কার্তিকে ফকির লালন শাহের তিরোধান দিবস আসছে। ভাবছি, লালন যখন তিরোহিত, তিনি যখন জীবদেহে স্বয়ং হাজির নাই, তখন তাঁর ডাকনাম কেন্দ্র করে বাংলার ভাবান্দোলনের অভিমুখ কোনদিকে ফেরালে তাঁকে ‘বর্তমান’ করে তোলার সম্ভাবনা তৈরী হয় বা হতে পারে। লালনকে নানান দূষণ থেকে রক্ষা রেখে বিশুদ্ধ রাখার বাসনার প্রসঙ্গ টানছি আলোচনায় সহজে প্রবেশ করবার জন্য।

বাংলা ১২৯৭ সালে (খ্রিস্টিয় ১৮৯০) তাঁর তিরোধানের পর ১২১ বছর পেরিয়ে যাচ্ছে। এই দিনে কুষ্টিয়ার ছেঁঊড়িয়ায় তাঁর ভক্ত, অনুসারী ও অনুরাগীরা ছোটখাট যে অনুষ্ঠান করতেন সেটা এখন লালন একাডেমির সরকারী অনুষ্ঠানে রূপ নিয়েছে। তিরোধানের দিন তো শোকের দিন। কিন্তু এখন সেটা আর শোকের দিন হিশাবে নয়, রীতিমতো উৎসব হিশাবে পালন করা হয়। এছাড়া ফকির লালন শাহ জীবদ্দশায় দোল পূর্ণিমায় যে ‘সাধুসঙ্গ’ করতেন সেই দিনটি সাধুগুরুরা সাধুসঙ্গ হিশাবেই পালন করে আসছিলেন। কিন্তু সেটাও এখন একটা মেলায় পরিণত হয়েছে। লালন একাডেমি দোলপূর্ণিমাতেও সরকারী ভাবে মেলা বসান। সাধুগুরুদের এখন কমই দেখি। পনের বিশ বছর আগেও ছোট ছোট দলে বিভিন্ন জায়গায় রাতভর গান আর তত্ত্বালোচনা দেখেছি। এখন হল্লা বেড়েছে। সাধুগুরুদের আগমন কমেছে। এলেও তাঁরা একদিন এক রাত থেকে চলে যেতে দেখি। তত্ত্বালোচনা একদমই হয় না, সেটা বলা যাবে না। কিন্তু তার মগ্নতা ও গভীরতা কমেছে, অন্যদিকে সেটা ক্রমাগত চাপা পড়ে যাচ্ছে কোলাহলে।

গত কয়েক দশকে নিজের চোখের সামনেই ছেঁঊড়িয়াকে বদলে যেতে দেখেছি। একই সঙ্গে দেখেছি লালনপন্থী সাধুগুরুদের মধ্যেও লালন চর্চার রূপান্তর। যে জীবন চর্চা আগে সম্ভব ছিল, গ্রামে সেই জীবন ধারণ এখন অসম্ভব হয়ে উঠেছে। চর্চাও বৈষয়িক কারণে বদলে যাচ্ছে। লালনের গান চর্চার মধ্যেও রূপান্তর ঘটেছে। আগে শিল্পী গড়ে উঠত বিভিন্ন সাধুসঙ্গে গান গেয়ে এই ভাবের পরিমন্ডলে পরীক্ষা দিয়ে। এখন তারা উঠে আসতে চায় ‘বাংলাদেশ তোমাকে খুঁজছে’ ধরনের অনুষ্ঠানের বিচারকদের সন্তুষ্ট করে। শিল্পীর খ্যাতি বা সাফল্য লালনপন্থী সাধুগুরুদের সন্তুষ্টি অর্জনের ওপর আর নির্ভরশীল নয়। লালনের গানের সঙ্গে  আর লালনের জীবন ও ভাবচর্চার একটা বিচ্ছেদ ঘটে গিয়েছে। ‘লালন গীতি’ নামে সাধকের জীবন চর্চা থেকে আলাদা করে যে ছেদটা টানা হয়েছিল সেটা এখন পূর্ণ বিচ্ছেদে পরিণত হয়েছে। ‘লালন গীতি’ নামে একটা গানের ঘরানা তৈরী হয়েছে যার সঙ্গে সাধক জীবনের কোন সম্পর্ক নাই। ব্যান্ড শিল্পীরাও লালন গাইছেন। নাচাকুঁদা করছেন। নতুন মাধ্যম নতুন যে শ্রোতা শ্রেণী তৈরী করেছে তাদের মনোরঞ্জনের ওপর সেই গীতির গায়কী নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। সাধুসঙ্গে যে গান ভাবচর্চার অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে নিজের বিকাশ ঘটাত, সেই চর্চার পরিমন্ডল থেকে গান আলাদা হয়ে গিয়েছে। আজকাল আবার ছেঁউড়িয়ায় দেখি হিন্দি গানের সুরে লালনের গান সুর করবার চেষ্টা। মোট কথা, পুরানা সম্পর্ক পুরানা প্রতিষ্ঠানগুলো সব ভেঙ্গে যাচ্ছে, বদলে যাচ্ছে।  শ্রুতি ও কণ্ঠনির্ভর সংস্কৃতির মধ্যে ভাবচর্চার যে ধারা এতোকাল বিকশিত হতে পেরেছে, অক্ষর, মূদ্রাযন্ত্র বা ডিজিটাল যুগে তার ধারাবাহিকতা রক্ষা কঠিন। সেটা আদৌ সম্ভব কিনা, কিম্বা সম্ভব হলে তার চর্চার রূপ কেমন হবে সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। যার মীমাংসা হয় নি।

বাজার এখন সর্বব্যাপী, পুঁজিই এই যুগে ধর্ম। ফলে পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে ফকির লালন শাহের একটা বদল ঘটবে। ঘটছেও। কিন্তু সবকিছুকে পণ্যে রূপান্তরের প্রক্রিয়া তীব্র হবার কারণেই ফকির লালন শাহের বিশুদ্ধতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে  কথাটা পুরাপুরি সত্য নয়। বাজার ব্যবস্থা সর্বব্যাপী হয়ে ওঠার আগেও বদল ঘটছিল। যদি রাষ্ট্রের দিক থেকে দেখি তাহলে দেখব লালন একাডেমি প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে মতিজান-লালনের কবর ও স্মৃতিক্ষেত্র থেকে ফকিরদের উৎখাত প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে অনেক আগে। গুরুবাদী ফকির লালন শাহ কবর পূজারি ছিলেন না। কিন্তু যেখানে তিনি দেহ রেখেছেন সেটা এখন ‘মাজার’ হয়ে গিয়েছে। এখন দেখি আরবি লেখা গিলাফ দিয়ে মতিজান ও তাঁর সমাধিও মাঝে মধ্যে ঢাকা হয়। লালনের জীবদ্দশায় মলম শাহের যে বাড়ি তাঁর আখড়া ছিল সেখানে তার চর্চার ধারা আর তাঁর তিরোধানের পরে তাঁর শিষ্যদের মধ্যে চর্চার ধারার মধ্যেও ছেদ পড়েছিল। তাঁর দুই শিষ্য মনিরুদ্দিন ও ভোলাই শাহের মধ্যে মতপার্থক্য ও আখড়ার মালিকানা নিয়া ঝগড়াবিবাদের ইতিহাস আমাদের জানা। ফকির লালন শাহের নামে তার শিষ্যরা যা টিকিয়ে রেখেছেন তাদের প্রত্যেকে ফকির লালন শাহকে যে যেমন বুঝেছেন তেমনি চর্চা করেছেন। তাঁরাও তাদের মত করেই বাংলার সাধনা বা ভাবচর্চার ধারায় অবদান রেখেছেন। অর্থাৎ লালনের শিষ্যদের মধ্য দিয়ে লালনের বিশুদ্ধ কোন ধারা বহাল থাকে নি। এই বিশুদ্ধতার অনুমানে ফকির লালন শাহ নিজেও সায় দিতেন না। আখেরি নবী সম্পর্কে তাঁর নিজের একটা গান রয়েছে এই রকম:

নবির সঙ্গে ছিল ইয়ার চারজন

চারকে দিলেন নবি চারমত যাজন

নবি বিনে পথে গোল হোল চার মতে

ফকির লালন বলে যেন গোলে পড়িস নে।।

নবির চার সাহাবাকে নবী চার রকম যাজন বা শিক্ষা দিয়েছিলেন। নবির তত্রোধানের পর চারজন চার ভাবে নবিকে ব্যাখ্যা করেছেন। এই গোলমালে পড়া যাবে না। এটা তো ফকির লালন শাহ সম্পর্কেও সত্য। তার তিরোধানের পর তাঁর শিষ্যরা যে যেমন বুঝেছেন তেমনি করেই লালনকে ব্যাখ্যা করবেন, তাঁর শিক্ষা ও নির্দেশাবলী চর্চা করবেন, এটাই হবার কথা। তেমনি করেই তারা চর্চা করেছেন। যতটুকু তাঁরা বুঝেছেন ততোটুকুই তাঁরা তাঁদের জীবনে ফকির লালন শাহকে ‘বর্তমান’ করে তুলেছেন। ফকির লালন শাহের এখন যে খ্যাতি বা পরিচিতি সেটা তাঁর শিষ্যদের জীবন ও ভাবচর্চার খ্যাতি নয়। লালনের খ্যাতির জন্য তাঁর গানের ভূমিকা মুখ্য। কিন্তু সেই ক্ষেত্রেও কথা আছে। লালনের গান এর আগে খোদা বক্স, মকসেদ আলীসহ আরো অনেকে গেয়েছেন। তাদের একটা পরিচিতিও রয়েছে। লালনকে জীইয়ে রাখার ক্ষেত্রে তাঁদের অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু শহরের মধ্যবিত্তের মধ্যে তাঁরা বিশেষ কোন আবেদন তৈরী করতে পারে নি। এমনকি আবদুল আলিম যখন লালনের গান বেতারে গাইলেন এবং তুলনামূলক ভাবে অধিক জনপ্রিয় করলেন তখন সেই গানগুলো মধ্যবিত্ত শ্রেণী ‘পল্লীগীতি’ হিশাবেই শুনেছে। পল্লীগীতি হিশাবেই কিছু শ্রোতা আবদুল আলিম তৈরী করতে পেরেছিলেন। যেমন, ‘ও যার আপন খবর আপনার হয় না’, ‘কে কথা কয়রে দেখা দেয় না’, ‘চিরদিন পুষলাম এক অচিন পাখি’, ‘এই দেশেতে এই সুখ হোল’ ইত্যাদি গান তার মারফত পল্লীগীতি হিশাবে জনপ্রিয় হয়েছিল। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে ‘লালনগীতি’ নিজের পরিচিতি নিয়ে হাজির হওয়া শুরু করে স্বাধীনতার পর ফরিদা পারভিনের গলা ও গায়কী ধরে। স্বাধীনতা আমাদের নিজেদের সম্পর্কে নতুন আগ্রহ তৈরী করবার কারনে এটা ঘটেছে, নাকি এই সময় টেপ ও ক্যাসেট রেকর্ডার ভূমিকা রেখেছে সেটা নির্ণয় করা গবেষণার বিষয়।

এই দিকগুলো মনে রাখলে লালনকে বিশুদ্ধ রাখার চিন্তার মুশকিল আমরা ধরতে পারব। আসলে ফকির লালন শাহ তাঁর গানের জন্য যে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন সাধক ও ভাবুক হিশাবে প্রতিষ্ঠা পান নি বললেই চলে। এই অভাবের কথা মনে রেখেই প্রশ্ন তোলা যায় ফকির লালন শাহকে কেন্দ্র করে বাংলার ভাবান্দোলনের যে-চর্চা এখন জারি আছে, তার অভিমুখ কোনদিকে ফেরালে তাঁকে ‘বর্তমান’ করে তোলার সম্ভাবনা তৈরী হয় বা হতে পারে। সোজা কথায় লালনকে কিভাবে বুঝলে ও চর্চা করলে তিনি এই কালে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন?

[দুই]

শুরুতেই বলা যায় ফকির লালন শাহের বিশুদ্ধতা রক্ষার বাসনা শেষাবধি প্রতিক্রিয়ায় পর্যবসিত হয় কিম্বা পর্যবসিত হবার বিপদে পড়ে। এই বাসনা ত্যাগ করা দরকার। লালন যখন জীবিত ছিলেন তখনও তাঁকে কিম্বা তার চর্চা ও গানকে বিভিন্ন জাত ও শ্রেণী নিজের নিজের জায়গা থেকেই ব্যাখ্যা করেছে। লিঙ্গভেদে লালনের তাৎপর্যও ভিন্ন হয়েছে। তাহলে বিশুদ্ধ লালনকে খুঁজব কোথায়? অর্থাৎ জাত, শ্রেণী ও নারীপুরুষ ভেদের দিক থেকে বিভিন্ন লালন তো আছেই তার ওপর বাজার লালনের যে ভূত নির্মাণ করে সেটা যেমন আপত্তির, ঠিক একই ভাবে তার বিপরীতে লালনকে ‘বিশুদ্ধ’ ভাবে পাঠ ও হাজির করবার বাসনাও সমান মুশকিলের।

তবে লালনকে বাজারের বিষয়ে পরিণত করার বিরোধিতা মাত্রই নেতিবাচক নয়। ইতিবাচক বিরোধিতার বাসনা ভিন্ন। সেই বাসনাকে বিশুদ্ধ লালন সন্ধানের আকুতির মধ্যে চেনা যাবে না। বরং তার আকুতি বিদ্যমান ব্যবস্থার প্রতিরোধ ও রূপান্তরের বাসনার মধ্যে। এই বাসনার চরিত্র রাজনৈতিক হতে বাধ্য। সেই বাসনার দিক থেকে দেখলে বাংলার ভাবচর্চার দরকারি অভিমুখটা শনাক্ত করা সহজ হয়। এই পথেই লালনকে বর্তমান করে তুলবার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। এই অভিমুখটা স্পষ্ট হলে ফকির লালন শাহ জীবনযাপন ও ভাবচর্চার মধ্য দিয়ে যে-জগতটা তৈরী করবার সাধনা করেছেন তাকে চেনা, জানা ও বোঝার চেষ্টা অনেক বেশী ফলপ্রসূ হতে পারে। নইলে ফকির লালন শাহ এবং তার অনুসারী ও অনুরাগীরা বড়জোর নৃতাত্ত্বিক বা সমাজতাত্ত্বিক গবেষণার বিষয় হয়ে উঠবেন; বিদ্যমান ব্যবস্থার প্রান্তিক অনুষঙ্গ হিশাবে থাকবেন তারা। বাউল ফকির হিশাবে বর্তমান ব্যবস্থার মধ্যে তাদের অন্তর্গত করে নেবার জন্য যেটা দরকার। এর অধিক কিছু হবে না। বিদ্যমান ব্যবস্থার প্রতিরোধ ও রূপান্তরের বাসনা থেকে কাজ করা না হলে এখনকার লড়াই সংগ্রামে ফকির লালন শাহ প্রাসঙ্গিক হবেন না। বিদ্যমান ব্যবস্থার প্রতিরোধ ও রূপান্তরের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক করে তোলাকেই আমরা তাঁকে ‘বর্তমান’ করে তোলা বলছি।

কিভাবে এই অভিমুখটা নির্দিষ্ট করা যায় সেই বিষয়ে দুই একটি প্রস্তাব দেবার জন্যই এই লেখা। প্রথমেই যে দিকটা স্পষ্ট করা দরকার সেটা হোল আমাদের কিছু অভ্যাস বদলানো জরুরী। ফকির লালন শাহকে মরমি বা আধ্যাত্মিক পুরুষ হিশাবে ভাবতে আমরা অভ্যস্ত; এই অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। লালন বেদকোরান শাস্ত্রকথা বা কোন কানকথা বা লিখিত কথাকে আক্ষরিক সত্য বলে মেনে নেন নি। আমরা জগতকে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক, দৈহিক ও আধ্যাত্মিক ইত্যাদি ভাগে ভাগ করতে অভ্যস্ত। এই অভ্যাসের জায়গা থেকে লালনকে বোঝা কঠিন। লালন মানুষের ভজনা করেছেন। সেখানে ইহলোক/পরলোক ভেদ নাই, দেহ ও আত্মার বিভাজন নাই। আমরা যেহেতু আত্মাকে দেহ থেকে আলাদা করে ভাবতে অভ্যস্ত, ফলে দেহসাধনার কথা শুনলে আমরা তাকে দৈহিকতা ছাড়া আর কিছু বুঝি না। এই দৈহিকতার মানেও আমাদের কাছে হয়ে ওঠে যৌনতার চর্চা। এর ফলে দেহের বাইরে যে আসলে ‘মানুষ’ নামক বিমূর্ত কিছু নাই, এই অতি প্রাথমিক ‘বস্তুবাদী’ শিক্ষা আমাদের নজরের আড়ালে চলে যায়। তখন লালনকে বুঝতে গিয়ে আমরা নানান গুহ্য সাধন প্রণালী, চারিচন্দ্র ভেদ ও নানান আচার-অনুষ্ঠানকে মুখ্য জ্ঞান করা শুরু করি। যেহেতু গোপন ও রহস্যময় জগতের দিকে মানুষের একটা স্বাভাবিক কৌতূহল থাকে, তখন গোপন যৌনচর্চার আলোকে লালনকে এক রহস্যময় পুরুষ হিশাবে গড়ে তোলা হয়। এর পরিণতি কি হতে পারে সেটা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘মনের মানুষ’ উপন্যাস ও সেই  উপন্যাস নিয়ে গৌতম ঘোষের বানানো ছবির উল্লেখ করা যেতে পারে। যেখানে লালন চন্দ্র কর নামে এক চরিত্র বানানো হয়েছে যে রীতিমত রতিগ্রস্ত। তার গুরু তাকে মেয়ে সাপ্লাই দেয়। যৌনতার চর্চা ছাড়া তার অন্য কোন সাধনা নাই। নারী যার কাছে নিছকই সাধনার উপায় বা তথাকথিত ‘সাধনসঙ্গিনী’।  সেখানে লালন এমনই এক ব্যক্তি যে কোন চিন্তা করতে জানে না, গান বা বাক্য তার মধ্যে আপনা আপনি আসে, আপনা আপনি পয়দা হয়। ইত্যাদি।

ওপরে ‘বস্তুবাদী’’ কথাটা উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছি এ কারণে যে বস্তু ও ভাবের বিভাজন মেনে ‘বস্তুবাদ’’ ও ‘ভাববাদ’ হিশাবে যেভাবে আমরা চিন্তাকে পরস্পর বিরোধী গ্রোতে বিভক্ত করি, লালনকে বুঝতে হলে এই বিভাজনের ফাঁদে পা দিলে চলে না। দুইয়ে দুইয়ে জগতকে বিভক্ত করে ভাববার অভ্যাস ত্যাগ করার দিক থেকে থেকে আমরা লালনকে ‘বর্তমান’ করে তোলার অভিমুখ নির্দিষ্ট করবার প্রথম সূত্রটা তাহলে আমরা এখানে পাচ্ছি।

দ্বিতীয়ত বাংলার ভাবান্দোলনের জাতপাত, শ্রেণী ও নারীপুরুষ ভেদ বিরোধী যে রাজনৈতিক ধারা শ্রীচৈতন্য-নিত্যানন্দের আমল থেকে শুরু হয়েছিল ফকির লালন শাহের আবির্ভাব ও বিকাশ নদিয়ার সেই ভাবের মধ্যেই। এই রাজনীতিই লালনের আবির্ভাবকে সম্ভব করে তুলেছে। জাতপাতবিরোধী নদিয়ার এই ভাবের বিকাশের ক্ষেত্রে ফকির লালন শাহের গুরুত্ব অপরিসীম। এর রাজনৈতিক দিকটা বোঝার জন্য শ্রীচৈতন্যের সমসাময়িক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসটা আমাদের জানা দরকার এবং সেই প্রয়োজনে সুলতানি আমল ও ইসলামের ভূমিকা বোঝা জরুরী। এই ক্ষেত্রে কাজ হয়েছে খুবই কম, যদিও সম্প্রতি কিছু কিছু অগ্রগতি হয়েছে।

যে ভাবগত জায়গায় দাঁড়িয়ে ফকির লালন শাহ মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ও ভেদবুদ্ধির রাজনীতির বিরোধিতা করেছেন তাকে বিশেষ ভাবে বোঝা দরকার। সেই ক্ষেত্রে তাঁর ভাবুকতা ও রাজনীতিকে আমরা আলাদা করতে পারি না। মানুষের ভজনা করেছেন তিনি, কিন্তু মানুষে মানুষে সমান এই বুর্জোয়া সাম্যবাদ ফকির লালন শাহ প্রচার করেন নি। তার মধ্যে এই প্রকার কোন ‘মানবতাবাদ’ নাই। তাহলে মানুষে মানুষে ভেদাভেদের বিরোধিতার যুক্তিটা তিনি কিভাবে খাড়া করেছেন? তাঁর যুক্তি হচ্ছে, ‘‘ব্রাহ্মণ, চন্ডাল, চামার, মুচি সকলেই এক জলে সূচি’’। সকলেরই সূচনা ‘‘একই জল’’। রজোবীজের প্রাকৃতিকতায় সকল মানুষের সূচনা ঘটেছে ‘‘একই জলে’’। মানুষের মধ্য দিয়েই মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে। প্রকৃতি, প্রক্রিয়া বা প্রাকৃতিকতার দিক থেকে অভেদ প্রতিষ্ঠার এই বিশিষ্টতার দিকে নজর রাখা দরকার। ‘দেহ’ কেন বাংলার ভাবান্দোলনের কেন্দ্রীয় বিষয় সেটা আমরা এই ক্ষেত্রেও দেখছি।

তৃতীয় দিকটা হচ্ছে ‘ব্যক্তিগত সম্পত্তি’-র প্রশ্ন। যে-জীবন সাধকরা চর্চা করেছেন সেখানে ত্যাগের ভূমিকা প্রধান, এটা সহজেই বোঝা যায়। সম্পত্তি বা বিষয়আশয় ত্যাগের দিকটা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বিষয়-আশয় ত্যাগ করতে গিয়ে ফকির লালন শাহ ‘বর্তমান’-কে ত্যাগ করেন নি। বাস্তব জগতকে ত্যাগ করবার কথা বলেন নি। এখানে শিক্ষণীয় দিকটা হচ্ছে বিপ্লব বা আইন করে ব্যাক্তিগত সম্পত্তি উৎখাত করলে সেটা উৎখাত হয়ে যায় না। সেটা ফিরে আসে। কারণ ব্যক্তিগত সম্পত্তির সঙ্গে ‘আমি’ বা ‘আমিত্ব’ জড়িত। ‘আমি’-র মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পত্তি বা জগতকে ব্যাক্তিগত ভাবে ভোগদখলের বাসনা থেকে যায়। ‘আমি’ আবার নিজেকে সম্পত্তির দখলদার বা মালিক হিশাবে প্রতিষ্ঠিত করবার ফাঁক পেয়ে যায়। তাহলে বৈপ্লবিক রূপান্তরের প্রশ্ন এই ‘আমি’-র সঙ্গে মোকাবিলার প্রশ্ন। বিদ্যমান ব্যবস্থার বৈপ্লবিক রূপান্তরের রাজনীতির মধ্যে ব্যক্তির রূপান্তর প্রধান বিষয় হিশাবে গণ্য করবার একটা শিক্ষা এখানে আমরা পেতে পারি।

লালনকে সহজে বিপ্লবী রাজনৈতিক চর্চার দিক থেকে বোঝার জন্য ‘ব্যক্তিগত সম্পত্তি’-র দিক থেকে ওপরে কথা পেড়েছি। আসলে ব্যক্তিগত সম্পত্তির প্রশ্ন মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্ক নির্ণয়ের প্রশ্ন। একই সঙ্গে নিজের সঙ্গে নিজের এবং অপরের সঙ্গে আমার সম্পর্ক নির্ণয়ের প্রশ্নও বটে। এই সম্পর্ক নির্ণয়ের পদ্ধতি কি হবে? এই দিক থেকে যদি ভাবি তাহলে দেখি লালন যখন ‘জ্যান্তেমরা’’-র কথা বলেন তখন তার একটা গভীর রাজনৈতিক মানে দাঁড়ায়। লালন সাধকদের জ্যান্তে মরবার বা মৃত্যুর আগেই মরে যাবার চর্চা করতে বলেন। এর নগদ লাভ হচ্ছে তখন মানুষের আর মরণের ভয় থাকবে না। মরণের ভয় আছে বলেই মানুষের পরকালের ভয় আছে। পরকালের ভয় থাকার অর্থ হচ্ছে ধর্মতত্ত্ববিদ বা মোল্লাপুরোহিতের বিধান ও হুকুম মেনে নেওয়া। কিন্তু জ্যান্তেমরার অর্থের সন্ধানে আমরা আরও গভীরে যেতে পাই।

ঠিক যে জ্যান্তেমরার আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে জীবিত থেকেও মৃত হবার সাধনা করা। কিন্তু জীবিত থেকেও মরে যাওয়া আবার কিভাবে সম্ভব? সহজ কথায় এর অর্থ হচ্ছে  জীবের যে জীবমূলক বাসনা তাকে দমন করা। এতে মনে হতে পারে লালন জীবের জীবনকে অস্বীকার করছেন। আসলে তা নয়। আগেই বলেছি লালন ‘বর্তমান’ চর্চা করেন। অতএব জীবের জীবন ছাড়া মানুষের যে কোন জীবন হতে পারে না এই কান্ডজ্ঞান তো তাঁর অবশ্যই ছিল। শুধু তাই নয়। জীবের জীবনই সাধনার ক্ষেত্র এটাই তার মৌলিক প্রস্তাব। কারণ যাকে ‘পরম’ বা পরমার্থিক সত্য’ বলি তার আস্বাদন একমাত্র জীবের জীবনেই সম্ভব। তাহলে ‘জ্যান্তেমরা’ কথাটা জীবের জীবনকে অস্বীকার করা নয়, বরং জীবজীবনের সত্যকে নিঃশর্তে মেনে নেওয়া। জীবের জীবনে পরমের আস্বাদনের জন্যই পরমকে ‘বর্তমান’ করে তোলার জন্যই জ্যান্তে মরবার চর্চা করতে হবে।

কিন্তু জীবকে তাহলে মরবার সাধনা করতে হবে কেন? অর্থাৎ জীবমূলক কামনাবাসনা ত্যাগ চর্চার কি দরকার? দরকার কারণ মানুষ ‘জীব’ একথা সত্য, কিন্তু মানুষ শুধু জীব নয়। এ এমন এক জীব যার মধ্যে পরমার্থিক সম্ভাবনা নিহিত রয়েছে। মানুষ মাত্রেই পরম হয়ে ওঠার সম্ভাবনা নিয়ে হাজির। সেই সম্ভাবনাকে বর্তমান করে তোলা সম্ভব যদি জীবমূলক কামনাবাসনার জায়গায় মানুষ পরমের আকাঙ্ক্ষা — পরমার্থিক বাসনার চর্চা করতে শেখে। বিদ্যমান ব্যবস্থার রূপান্তর কামনা করা বাংলার ভাবুকতার দিক থেকে পরমার্থিক বাসনা।

অন্যদিক থেকে জীবের বাসনা মূলত ভোগের বাসনা। তাহলে জ্যান্তে মরার অর্থ মানুষের জীবনকে ভোগীর জীবনে পর্যবসিত হতে না দেওয়া। ভোগের জীবন ত্যাগ করার অর্থ হচ্ছে জগতের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককেও নতুন ভাবে বিন্যস্ত করা। জগত শুধু ভোগের বিষয় নয় এই শিক্ষা দেওয়া। জগত মানুষের কাছ থেকে আলাদা থেকে মানুষের বাইরে মানুষের ভোগের জন্য হাজির এ ভাবনা পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় গোড়ায় যেমন সক্রিয়, তেমনি পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণও এই জীবমূলক বাসনার মধ্যে। যদি এতটুকু আমরা বুঝি তাহলে জ্যান্তেমরা হবার জন্য খিলকা নিয়ে ফকিরিবেশ ধারণকে আমরা শুধু লালনপন্থীদের একটা আচার আকারে নয়, মানুষের পরমার্থিক সত্যকে বর্তমান করে তোলার আবশ্যিক চর্চা হিশাবে বুঝতে শিখব। ফকিরি রহস্যও আমাদের কাছে গুহ্য কোন ব্যাপার হয়ে থাকবে না।

আরও অনেক দিক নিয়ে আলোচনা দরকার। ওপরে যে তিনটি দিক নিয়ে কথা বলেছি সেই দিকে আমাদের নজর ফেরাতে পারলে কম অর্জন হবে না। লালন শাহকে নিয়ে অনেকে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছেন। ভবিষ্যতে আরো হবে। তাঁর সাধক জীবনের চর্চা ও অনুশীলন তিনি যেভাবে করেছেন তাকে যথাসম্ভব জানা দরকার। তাঁর সাধনার আচার, অনুশীলন বিধিবিধান কেমন ছিল? তিনি সাধুসঙ্গ করতেন কিভাবে? তাঁর ‘কালাম’ বা গানের যথাসম্ভব সঠিক পাঠ নির্ণয়ের উপায় কি? ইত্যাদি দিকগুলো জানা, বোঝা ও আলোচনার দরকার আছে সন্দেহ নাই। কিন্তু এই কাজগুলো তখনই এই কালে প্রাসঙ্গিক হবে যখন আমরা বাংলার ভাবান্দোলনের ঐতিহাসিক অভিমুখ ক্রমে ক্রমে নির্দিষ্ট করে তুলতে পারব। লালনের রাজনৈতিক-দার্শনিক তাৎপর্য যতো বেশী নিজেদের কাছে আমরা পরিষ্কার কর তুলব ততোই ফকির লালন শাহ আমাদের জন্য ‘বর্তমান’ হয়ে উঠবেন।

সোমবার, ৩ অক্টোবর, ২০১১

বাস্তবতার নাটক এবং নাটকের বাস্তবতা - ফ্লোরা সরকার

অ্যারিস্টটলের ‘কাব্যতত্ত্ব’র সঙ্গে আমাদের পরিচিত হতে সুদীর্ঘ দু’হাজার বছর অপেক্ষা করতে হয়। ইংরেজের হাত ধরে তা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়। বাংলায় গ্রিক সাহিত্যের সর্বপ্রথম রসজ্ঞ কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তিনি ছাত্রাবস্থায় গ্রিক শিখেছিলেন এবং পরবর্তীতে ১৮৭১ সালে গ্রিক থেকে ইলিয়াদের কিছু অংশ অনুবাদ করেছিলেন বাংলায়। তার গ্রিকচর্চার একটিই ফল- ‘মেঘনাদবধকাব্য’। এর কাহিনী রামায়ণের, গঠন হোমারের। মাইকেলের পরে হয়তো স্বল্পসংখ্যক বাঙালি গ্রিকভাষা শিখেছিলেন, কিন্তু তাদের শিক্ষার কোনো ফল আমরা পাইনি। মাইকেল অ্যারিস্টটলের ‘কাব্যতত্ত্ব’র চতুর্বিংশ অধ্যায়ের প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন, তবে তার সমসাময়িককালে ক’জনের সেদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছিল জানা নেই। সেই অধ্যায়ের এক জায়গায় অ্যারিস্টটল নাটকে অবিশ্বাস্য সম্ভাব্যতার চেয়ে বিশ্বাসযোগ্য অসম্ভাব্যতার প্রতিই শুধু জোর দেননি, তিনি সেইসব নাটককেই কেবল গ্রহণযোগ্য বলে উল্লেখ করেন। তার মতে, অব্যাখ্যেয় খুঁটিনাটি নিয়ে একটি কাহিনী গড়ে তোলা ঠিক নয়। যতটা সম্ভব অব্যাখ্যেয় বা অসম্ভাব্য ব্যাপার কাহিনীতে না থাকাই ভালো। তারপরের অধ্যায়ে, কাব্যের সমালোচনায় অ্যারিস্টটল আমাদের জানান- ‘চিত্রকর বা অন্যান্য শিল্পীর মতো কবিও জীবনের অনুকারক। কাজেই তাকে নিম্নের এই তিনটির যে কোনো একটি অনুকরণ করতে হবে, যেমন- (১) জীবন যেমন ছিল অথবা (২) জীবন যেমন আছে অথবা (৩) জীবন যেমন হওয়া উচিত।’ যে কারণে প্রাচীন গ্রিক নাট্যকারদের মধ্যে সোফোক্লেসকে আমরা দেখি, মানুষের জীবন যেমন হওয়া উচিত, তিনি সেভাবে মানুষের ছবি এঁকেছেন। নাট্যকার এউরিপিদেসকে আমরা দেখি মানুষ যেমন তেমন করেই তিনি মানুষের ছবি এঁকেছেন তার নাটকে। এই তিনটির যে কোনো একটি বৈশিষ্ট্য যদি কোনো নাটকে না দেখা যায় অ্যারিস্টটল বলেছেন, ‘কাহিনীটি এই রকমই’।
সেই সময়ের কবি ও দার্শনিক জেনোফোনেস ক্রুদ্ধ হয়ে এসব নাটকের কাহিনীকে সত্য থেকে দূরে থাকার উল্লেখসহ কাহিনীগুলোকে জনসম্মুখে আনার অযোগ্য বলে গণ্য করেন। বরং নাটকগুলোকে ‘প্রচলিত’ ধারার বলে উল্লেখ করেন। বাংলাদেশের বর্তমান টিভি চ্যানেলের নাটকগুলো জেনোফেনাস কথিত সেই প্রচলিত ধারার ধারাবাহিকতা মাত্র। এসব নাটক বাস্তবতা দূরে থাক নিজেরাই একটা বিকৃত বাস্তব নির্মাণ করে চলেছে, যার সঙ্গে জনগণের জীবনের কোনো সংযোগ নেই। এসব সংযোগহীন নাটক নিয়ে আলোচনার আগে মঞ্চ এবং টিভি নাটকের পার্থক্যটুকু আমাদের একটু ভেবে নেওয়া দরকার।
নাটককে বলা হয় দৃশ্যকাব্য। অর্থাৎ দৃষ্টির সম্মুখে প্রদর্শিত শিল্পমাধ্যম। নাটক মঞ্চ দিয়ে শুরু হলেও, পরবর্তীতে তার বিস্তার বিভিন্ন মাধ্যমে এগিয়ে যায়। টিভি নাটক যার মধ্যে অন্যতম একটি মাধ্যম। কিন্তু টিভি নাটক এবং মঞ্চ নাটকের ব্যবধান অনেক। কেননা, মঞ্চ একটি নির্দিষ্ট জায়গায়, কয়েকটি সেটের মধ্যে প্রদর্শিত হয়। আর টিভি নাটকের কোনো সুনির্দিষ্ট স্থান নেই। গল্পের প্রয়োজনে তা স্থান-কাল পরিবর্তিত হয়। মঞ্চনাটক সংলাপনির্ভর, টিভিনাটক স্বল্পসংলাপনির্ভর। টিভিনাটকে ফ্লাশব্যাক-ফ্ল্যাশইন যতটা স্বাচ্ছন্দ্য, মঞ্চে ততটা নয়। মঞ্চের সংলাপ অনেকটা যাত্রার ঢং-এ উচ্চারিত হলেও, টিভিনাটকের সংলাপে উচ্চস্বরের প্রয়োজন পড়ে না। মঞ্চে শিল্পীর অভিব্যক্তি যতটা তীব্রতার প্রয়োজন পড়ে, টিভিনাটকে ততটা প্রয়োজন পড়ে না। কারণ মঞ্চে দর্শক এবং শিল্পীর দূরত্ব যতটা তার চাইতে টিভিনাটকের ক্যামেরা ততটাই কাছাকাছি। মঞ্চনাটকে মঞ্চে একসঙ্গে অনেক শিল্পীর সমাগম ঘটে, কদাচিৎ একক শিল্পীকে মঞ্চে দেখা যায়, টিভিনাটকে কমসংখ্যক শিল্পীর সমাগমই অধিক। এরকম আরো পার্থক্য দেখানো যেতে পারে।
কিন্তু টিভিনাটকের ক্ষেত্রে যে সমস্যাটা হয় তা হলো টিভিনাটক কিছুটা মঞ্চ, কিছুটা সিনেমার মাঝামাঝি। মঞ্চ এবং সিনেমার মাঝে পড়ে টিভিনাটকের আলাদা কোনো বৈশিষ্ট্য আমরা আজ পর্যন্ত খুঁজে দেখিনি বা চিন্তাভাবনা করিনি। তবে মঞ্চ বা টিভিনাটকের মাঝে পার্থক্য যা-ই থাক, গল্প বা কাহিনী বর্ণনার কিছু মূল ব্যাকরণ থাকে, যেসব ব্যাকরণ স্থান-কাল নিরপেক্ষ। ব্যাকরণের কোনো পরিবর্তন যেমন হয় না তেমনি মঞ্চনাটক, টিভিনাটক বা সিনেমার ব্যাকরণ কখনো পরিবর্তিত হয় না। অর্থাৎ পথ ভিন্ন হলেও গন্তব্য একই জায়গায় থাকে। সেটা অ্যারিস্টটল কথিত, জীবন যেমন ছিল বা জীবন যেমন বা যেমন হওয়া উচিত, তার যে কোনো একটা হতে পারে। এখন প্রশ্ন হলো আমাদের টিভিনাটকে উল্লিখিত বৈশিষ্ট্য দূরে থাক, সেসব নাটকে আমরা কী আদৌ কোনো জীবন দেখতে পাই?
টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রতিদিন অসংখ্য নাটক প্রচারিত হয়। এসব নাটক নিয়ে ইতোমধ্যে বিভিন্ন মহলে বিভিন্নভাবে উষ্মা প্রকাশ করতেও দেখা গেছে। অনেকে আজকাল টিভি দেখা একরকম ছেড়েই দিয়েছেন। খবরটুকু ছাড়া আর কোনো বিনোদন দর্শকরা টিভি চ্যানেলগুলোতে খুঁজে পান কিনা সন্দেহ। কিন্তু বিশেষ নাটকগুলোও যখন যেনতেনভাবে টিভিতে প্রচারিত হতে দেখা যায় তখন বিষয়টা অত্যন্ত দুঃখজনক হয়ে দাঁড়ায়। প্রতিবছর প্রচুর ঢাক-ঢোল বাজিয়ে ঈদের লম্বা ছুটিতে লম্বা দিনের, কোনোটা ছয়দিন, কোনোটা সাতদিন, কোনোটা আবার আটদিনের আয়োজনে প্রচুর বিশেষ নাটক প্রদর্শিত হয়। হাতেগোনা কয়েকটা নাটক ছাড়া সেই সময়টাতে টিভির সামনে বসে থাকাই একটা যন্ত্রণাদায়ক হয়ে দাঁড়ায়। এখন এবারের ঈদের সেসব তথাকথিত বিশেষ নাটকের কয়েকটা বিশ্লেষণ করে দেখা যাক।
প্রেম-রোগ থেকে টিভিনাটকের কোনো নিস্তার নেই। নিস্তার নেই সিরিয়াল রচনা থেকেও। প্রেমের নাটকের ভাইরাসের মতো আমাদের সিরিয়াল নাটকগুলোও একই রকম ভাইরাসে আক্রান্ত। সারাবছর সিরিয়ালের প্রদর্শনের পাশাপাশি ঈদের বিশেষ নাটকগুলোতেও এই সিরিয়াল নামক ভাইরাস তার বিস্তার ঘটিয়েছে। ‘প্রেমের নাম বেদনা’ নামের নাটকটি গত ঈদে দুই পর্বে প্রচারিত হয়। প্রথম পর্বে দেখা যায়, অভিনয় করতে এসে নায়িকা একটি সমস্যার মুখোমুখি হয়। সমস্যাটি কী? না কোনো আর্থিক বা সামাজিক সমস্যা নয়, সমস্যা একটাই আর তা হলো পরিচালক তার প্রেমে পড়েন এবং নায়িকা সেই প্রেমে সাড়া দিতে পারেন না। ফলে তার অভিনয় জগতে প্রতিষ্ঠা পাওয়া হয় না। অর্থাৎ দর্শককে এটাই বোঝানো হয় যে- নাটকে প্রতিষ্ঠা পেতে হলে পরিচালকদের প্রেমে পড়তে হবে। নাটকের আরেকজন নায়িকাও অভিনয় করতে আসেন এবং পরিচালক তারও প্রেমে পড়েন, নায়িকা সাড়া দেন এবং তাদের যথারীতি বিয়ে হয়ে যায়। অর্থাৎ একই মানুষ একই সময়ে দুজনের প্রেমে পড়তে পারেন।
এবারের ঈদে সেই নাটকের সেই সিরিয়ালে দেখা যাবে, প্রথম নায়িকা এবার পরিচালকের প্রেমে পড়েছেন। কিন্তু অপর নায়িকা তার স্বামীকে (সেই পরিচালক) ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব বিকৃত বাস্তবতার উপস্থাপন দিয়ে দর্শককে আদৌ কোনো আনন্দ প্রদান করা যায় কিনা তা ভেবে দেখা দরকার।
এবারের ঈদের আরেকটি নাটক ‘হাতে মাত্র পাঁচদিন’ নাটকে দেখা যাবে ছবি তোলার নেশায় নায়ক ঢাকা থেকে কক্সবাজার ছুটে যায়। সেখানে যথারীতি নায়িকার সঙ্গে পরিচয় হয়। কিন্তু নায়িকার জীবনে একটা অতীত আছে, নায়ক-নায়িকার সেই অতীত থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য তার কাছে পাঁচদিন সময় চায়। মজার বিষয় হলো, বাস্তবে কেউ দ্রুত প্রেমে না পড়লেও আমাদের নাটকে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে নায়ক-নায়িকারা প্রেমে পড়ে যান। কারণ ‘প্রেম’ নামক বিষয়টিকে যেভাবেই হোক নাটকে আনা চাই। ‘ভালোবাসার রং’ নাটকে দেখা যাবে, নায়ক আমেরিকা থেকে ফিরছে। তাকে রিসিভ করতে যাওয়ার সময় নায়িকা জানতে পারে নায়ক বিমান দুর্ঘনায় মারা গেছে। নায়িকা সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। একসময় সে মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলে নায়িকা। তাকে সুস্থ করার জন্য আরেকজন নায়ক যিনি আবার পেশায় ডাক্তার তিনি ছুটে আসেন। নায়িকা সুস্থ হতে থাকে এবং যথারীতি সেই ডাক্তারের প্রেমে পড়ে। তারা বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয় এবং বিয়ের আসরে হিন্দি ছবির ঢং-এ প্রথম নায়ক এসে উপস্থিত হয়। এধরনের উদ্ভট গল্প সাজিয়ে পরিচালকই বা দর্শকদের কী বোঝাতে চান আর দর্শকই বা কী বুঝে কতটুকু বিনোদন পান তার সঠিক পরিমাপ আমাদের জানা নেই।
ত্রিভুজ প্রেমে ইদানীং সম্ভবত সবার ক্লান্তি এসে গেছে। তবু এবারের ঈদে ‘শুকতারা’ নাটকে তিন তারা (নোবেল, তারিন, মিলন) বেষ্টিত ত্রিভুজ প্রেমের কাহিনী আমরা দেখতে পাব। আরেকটি ঈদের নাটকে নায়ককে দেখা যাবে ধনী নায়িকার বাড়ির প্রহরীর চরিত্রে। গল্পের বাকিটা জানা থাকলেও আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না, সেই প্রহরী নায়কের সঙ্গে ধনী নায়িকার অবশ্যই প্রেম সম্পন্ন হবে। সংখ্যা বাড়িয়ে লাভ নেই, ঈদের প্রায় প্রতিটি নাটকের কাহিনী কম-বেশি একই ছাঁচে গড়ে তোলা হয় প্রতি বছর। যেসব নাটকের বাস্তবতা জীবনের বাস্তবতা থেকে থাকে শতহস্ত দূরে। সাধারণ মানুষের একটা ভ্রান্ত ধারণা আছে আর তা হলো ইন্দ্রিয় দ্বারা সে যা দেখে বা বোঝে তাকেই সে চরম বলে ভেবে বসে। আর এই সুযোগটাই আমাদের নির্মাতারা গ্রহণ করেন। ইচ্ছেমত মনগড়া বিকৃত সব কাহিনী সাজিয়ে উপস্থাপন করেন টিভি দর্শকদের সামনে। মানুষ তার জীবনে যা করে বা যা বলে তার চেয়ে বেশি সে ভাবে। জীবন যেমন বা যেমন হওয়া উচিত যেভাবেই আমরা জীবনকে নাটকে উপস্থাপন করি না কেন, শুধু সংলাপের পর সংলাপ সাজালেই তার উপস্থাপন সঠিক হয় না, জীবনের না-বলার একটা বৃহৎ অংশ থাকে, যার উপস্থাপন খুব সহজকর্ম নয়। আর তাই ‘ভাবি কেমন আছেন’ বা ‘ইস্! মাইয়াডা তো খুব সুন্দর’ জাতীয় কথামালার কথা দিয়ে সাজিয়ে তোলা হয় আমাদের তথাকথিত টিভিনাটকগুলো।
যা পাঠযোগ্য তা দর্শনযোগ্যও বটে। যে জন্য আজও আমরা ইবসেন, ব্রেখট, শেক্সপিয়ার পাঠ করি। আমাদের টিভিনাটকের পান্ডুলিপি (অনেক নির্মাতার আবার সেই বস্ত্তটিও হাতের কাছে থাকে না। তারা এতটাই অাঁতেল যে পান্ডুলিপির প্রয়োজনই পড়ে না) পাঠযোগ্য হয় না বলেই তা দর্শনযোগ্য হতে পারে না। গ্ল্যামারাস নায়ক-নায়িকা, গ্ল্যামারাস পোশাক, গ্ল্যামারাস আসবাব, বাড়িঘর, আউটডোর সাজিয়ে দর্শকের চোখের দৃষ্টিকে শান্ত করা গেলেও মনের দৃষ্টিটা অশান্তই থেকে যায়। কারণ অন্তঃসারশূন্য কাহিনী দিয়ে আর যাই নির্মাণ করা যাক তা দিয়ে কখনোই ভালো নাটক নির্মাণ করা যায় না। অনেক নির্মাতা এবং দর্শককে আজকাল বলতে শোনা যায়- নাটকে এত সিরিয়াস কিছু দেখাবার দরকারটাই বা কী? বিনোদন থাকবে বিনোদনের জায়গায়। আমরাও এর সঙ্গে একমত। কিন্তু বিনোদনের নামে যখন প্রহসন করা হয় তখন বিষয়টা ভাবিয়ে তোলে বৈকি। ঈদের মোড়কে পোশাকের দোকানিরা যেমন সারা বছরের বাণিজ্য করে নেন এই সময়ে,  নাটকের নির্মাতারাও বছরের এই সময়টায় একই উদ্দেশ্যে বসে থাকেন। এতে হয় তো বাণিজ্য হতে পারে খুব ভালো, কিন্তু নাটক নির্মিত হয় না। নাটক শুধু পান্ডুলিপিনির্ভর কোনো শিল্পমাধ্যম নয়, তার সঙ্গে জড়িত থাকে সংলাপ, অভিনয়, শব্দগ্রহণ, আবহসঙ্গীত, সম্পাদনার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ। স্থানাভাবে আজ এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হলো না। পরবর্তী কোনো একসময়ে তা করা যাবে।
নাটক নামক শিল্পকর্মটি যে খুব সহজ কাজ নয় তা বিশিষ্ট চিন্তাবিদ, নাট্যকার দিদেরো তার একটি কথা দিয়ে আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন- ‘যিনি নাটক লিখবেন তাকে অবশ্যই প্রথমত একজন দার্শনিক হতে হবে, যিনি তার অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে নিজেকে এবং অপরকে দেখতে পাবেন, তাকে অবশ্যই মনুষ্য চরিত্র সম্বন্ধে খুব ভালোমতো অবগত থাকতে হবে, সে তার সামাজিক পরিবেশের ছাত্র এবং সেই সমাজের কার্যাদি, গুরুত্ব, সমাজের সুবিধা-অসুবিধার দিকগুলো অবগাহন করতে হবে। কোনো শিশুচিত্ত নাট্যকারের পক্ষে সমস্যামূলক নাটক লেখা সম্ভব নয়, কারণ সমস্যামূলক নাটকে প্রয়োজন হয় নান্দনিকতা, গভীর জ্ঞান, আভিজাত্যবোধ এবং বুদ্ধিমত্তার শক্তি। অন্তর্লোক এবং বহির্লোকের (মানুষ+চরিত্র+সমাজ+ব্যবস্থা) পরিপাটি জ্ঞান যার নেই তার পক্ষে মহৎ কিছু সৃষ্টি করা সম্ভব নয়।’ এসবই হচ্ছে নাটকের সেই ব্যাকরণ, যা কখনো পুরনো হয় না, বাণী চিরন্তনের মতো বেঁচে থাকে। আশা করব আমাদের বর্তমান নির্মাতারা কিছুটা হলেও তাদের জ্ঞানের ভান্ডারের চর্চা করবেন এবং আমাদের পতিত নাটকগুলো থেকে উদ্ধারের ব্যবস্থা করবেন। তখন আমরা নাটকের বিকৃত এসব বাস্তবতা নয়, বাস্তবতার প্রতিফলন, জীবনের প্রতিফলন নাটকে দেখতে পাব।

বুধবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১১

সিনেমার মৃত্যু এবং সাই মিং লিয়াং

২৬ মার্চ ২০১০, মালয়েশিয়ার বংশোদ্ভূত তাইওয়ানে বেড়ে ওঠা সাম্প্রতিক কালের অন্যতম বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সাই মিং লিয়াং তাইওয়ানের ন্যাশনাল সেন্টার ইউনিভাসির্টির একটি থিয়েটার হলে তার সর্বশেষ মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘দ্য ফেস’-এর প্রিমিয়ার উপলক্ষে ‘সিনেমার ব্যবহার এবং অপব্যবহার’ শীর্ষক বক্তৃতায় সিনেমার মৃত্যু, ফ্রান্সের অন্যতম চিত্রনির্মাতা ত্রুফোর প্রভাব ও অন্যান্য প্রসঙ্গে একটি উল্লেখযোগ্য ভাষণ প্রদান করেন।

সাই মিং লিয়াং মালয়েশিয়ার কুচিং প্রদেশে ১৯৫৭ সালের ২৭ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। তার জীবনের প্রথম ২০টি বছর মালয়েশিয়ায় অতিবাহিত হয়। তারপর বাবার কর্মসূত্রে তাইওয়ানের তাইপেতে চলে আসেন। তাইওয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা ও সিনেমা বিভাগ থেকে গ্র্যাজুয়েশন লাভ করেন। পরবর্তীতে থিয়েটারের প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার, চিত্র পরিচালক এবং হংকং টেলিভিশনের নাট্য পরিচালক হিসেবে নানা কাজে লিপ্ত হন। তবে চিত্র পরিচালক হিসেবেই তিনি খ্যাতি অর্জন করেন বেশি। ১৯৯৪ সালে ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে তার নির্মিত Vive L’Amour ছবিটি গোল্ডেন লায়ন (শ্রেষ্ঠ ছবি) পুরস্কারে ভূষিত হয়। ১৯৯৭ সালে বার্লিন আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে তার ‘রিভার’ ছবিটি সিলভার বিয়ার বা শ্রেষ্ঠ জুরি প্রাইজ লাভ করে। ‘দ্য হোল’ ছবিটি ১৯৯৮ সালের কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে FIPRESCI award পায়। নান্দনিক সৌন্দর্য্যের জন্য ২০০৫ সালে বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে The Wayward Cloud ছবি আলফ্রেড বাউয়ার অ্যাওয়ার্ড এবং সিলভার বিয়ার পায়। ২০০৭-এ I don’t Want to Sleep Alone ছবিটি যা মালয়েশিয়ায় চিত্রায়িত হয় এবং যে ছবিটি সেদেশের সংস্কৃতিগত, নৃতাত্ত্বিকগত এবং জাতিগত নানান অনালোকিত বিষয় উপস্থাপন করার কারণে মালয়েশিয়ান সেন্সরশিপ প্রথমে ছবিটি মুক্তি দিতে অপারগতা জানায়। পরে ছবির কিছু অংশ বাদ দিলে ছবিটি মুক্তি পায়। বছর দুয়েক আগে লুভ মিউজিয়ামের আর্থিক সহায়তায় তার সাম্প্রতিক মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘দ্য ফেস’ ইতিমধ্যে দর্শককুলে বেশ আলোড়ন তুলেছে। সব থেকে যা উল্লেখযোগ্য তা হলো- ২০০৩ সালে যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকা বিশ্বের ৪০টি শ্রেষ্ঠ চিত্রপরিচালকের মাঝে তাকে ১৮তম স্থানে স্থান দিয়ে সম্মানিত করে।
  সেই লিয়াং তাইওয়ানের একটি পরিত্যক্ত সিনেমা হলে ‘সিনেমার ব্যবহার এবং অপব্যবহার’ শীর্ষক বক্তৃতা দেন। পরিত্যক্ত সেই সিনেমা হল সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘শেষবার যখন এই থিয়েটার হলে আসি সেটা ছিল ২০০৩, যখন লি ক্যাং শেং (লিয়াংয়ের একমাত্র অভিনেতা, যিনি লিয়াংয়ের সব ছবিতে অভিনয় করেন, যাকে ছাড়া লিয়াংয়ের ছবি পূর্ণ হয় না) অভিনীত The missing-এর প্রিমিয়ার শো দেখানো হয়। এখানে যারা আছেন তাদের মাঝে খুব কম সংখ্যক মানুষই জানেন, এই হলের আসনগুলো ফু-হো থিয়েটার, যে থিয়েটারে ৮ থেকে ৯শ’ দর্শকের বসার ব্যবস্থা ছিল, সেখান থেকে আনা হয়েছে। সেই থিয়েটারে আমার অন্য একটি ছবি Goodbye, Dragon Inn’র (2003) শুটিং হয়েছিল। সেই সময় থেকেই এই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে একটি সিনেমা হল বা থিয়েটার হল প্রতিষ্ঠার একান্ত সমর্থক ছিলাম। ফু-হো থিয়েটার হলটি ভেঙে দিলে সেখানকার বেশিরভাগ আসন এখানে স্থানান্তরিত করা হয়, যেগুলো স্ত্তপ করে রাখা হয়েছিল অনেকদিন। আমার খুব ভালো লাগছে সেই হলের আসনগুলো এখানে কাজে লাগানো হয়েছে দেখে।…থিয়েটার হল সিনেমা শিল্পের অন্যতম একটি অপরিহার্য অংশও বটে।’’
    সিনেমার প্রতি শুধু প্রেম নয়, দরদ থাকলেই কেউ এভাবে একটি প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে এই রকম একটি হলের স্বপ্ন দেখতে পারেন এবং তা বাস্তবায়িত করতে পারেন। আমরা আমাদের অন্তত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে এই রকম একটি হলের কথা কী ভাবতে পারি না, যেখানে দেশীয় ছবির পাশাপাশি পৃথিবীর নান্দনিক, সুস্থ, সুন্দর ছবিগুলো আমাদের ছাত্র-ছাত্রীরা নিয়মিতভাবে দেখার সুযোগ পাবে?
    ভেনিসে তার বেশ কিছু ছবির একবার প্রদর্শনী হলে সেখানকার একজন ডাচ সমালোচক লিয়াংয়ের ছবি সম্পর্কে একটি চমৎকার মন্তব্য করেন এবং তা হলো – ‘‘সাইয়ের কাজ, সিনেমার মৃত্যু ঘটানোর মতো কাজ এবং একই সঙ্গে তা (সিনেমা) পুনরুজ্জীবিত করারও কাজ।’’ এই মন্তব্যের প্রেক্ষাপটে লিয়াং বলেন, ‘‘তার মন্তব্যের সব থেকে উদ্দীপক দিকটি হচ্ছে সিনেমার ‘পুনরুজ্জীবন’। সিনেমার ইতিহাসে আমরা প্রায়ই সমালোচকদের মুখে সিনেমার মৃত্যুর কথা শুনে থাকি। আশির দশকে এই ধরনের একটি আলোচনার ঝড় উঠেছিল যে, তাইওয়ানের ছবির মৃত্যু ঘটেছে। আসলে তা কী ছিল? এই আলোচনায় দর্শকরা বেশ ঘাবড়ে যান। গত বছর একজন জ্যেষ্ঠ জার্মান চিত্রপরিচালকের সঙ্গে আমার দেখা হয় এবং তিনিও বলেন, ১৯৮৪-এর দিকে, জার্মানির অন্যতম পৃথিবী খ্যাত চিত্র পরিচালক রেইনার ওয়ারনার ফাসবিন্ডারের মৃত্যুর (১৯৮২) পর পরই জার্মানিতেও ঠিক একই রকম আওয়াজ উঠেছিল অর্থাৎ জার্মান ছবির মৃত্যু ঘটে গেছে। জার্মান সরকার সিনেমার জন্যে সব ধরনের আর্থিক সহায়তা বন্ধ করে দেয় এবং চিত্রনির্মাতারা দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। সরকারি ঘোষণায় বলা হলো ছবি নির্মিত হবে সাধারণ দর্শকের মনোরঞ্জনের জন্য, ঠিক যেমন হলিউডে করা হয়। ফলে আশির দশকের পর থেকে যেসব ছবি সেখানে নির্মাণ করা হলো তার কোনো পরিচালকের নামই আমরা এখন আর করতে পারি না, অথচ আশির দশকের আগের সময়কার নির্মাতা যেমন ওয়ারনার হারজগ, ফাসবিন্ডার, উইম ওয়েন্ডার এদের নাম এখনো আমরা স্মরণ করি। আমি মনে করি এসবই বাজারিকরণের সঙ্গে সম্পৃক্ত। একটু কমবেশি হলেও পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশের চলচ্চিত্র শিল্প এরকম জাতীয় সিনেমার মৃত্যু ঘণ্টার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করেছে বা করছে। ছবির এই মৃত্যু বা উজ্জীবিত অবস্থা যাই হোক না কেন, আমার ছোটবেলাকার সময়ের কথা আমি বলতে পারি সেই সময়ে জনগণের জায়গার জন্য সিনেমা একটি অত্যন্ত আবশ্যকীয় স্থান ছিল। যা আপনারা আমার ‘ফেস’ ছবিটিতে দেখতে পাবেন।’’ অর্থাৎ সিনেমার যে মৃত্যু নেই, মৃত্যু হতে পারে না সে কথাই লিয়াং চমৎকার করে উপস্থাপিত করেছেন। বলাই বাহুল্য, আমাদের আজকের সিনেমা শিল্পের এই আকালের যুগে আমাদের চিত্রনির্মাতারাও লিয়াংয়ের কাছ থেকে প্রচুর অনুপ্রেরণা নিতে পারেন।
   শিল্প ও অ-শিল্প সম্পর্কে বলেন, ‘‘ছবি যদি শিল্প হয় তাহলে সেই কাজের ভেতর অবশ্যই একজন শিল্পীর প্রতিফলন ঘটাতে হবে। অবশ্যই কিছু বাণিজ্যিক ছবি নির্মিত হবে যেগুলোতে অনেক সময় শৈলীর ছোঁয়া পাওয়া যায় কিন্তু আমি শুধু মুনাফা তৈরির লক্ষ্যে ছবি নির্মাণ করি না। আমার ছবি আমার সৃষ্টির প্রতিফলন; আমার ছবি আমার জীবন থেকে অবিচ্ছিন্ন।’’ এই হলেন সাই মিং লিয়াং, ছবিকে যিনি মনেপ্রাণে শিল্প হিসেবে গ্রহণ করেছেন, কোনো মুনাফা উপার্জনের পথে হাঁটেননি। হাঁটেননি বলেই একের পর এক তার প্রায় সব ছবি পুরস্কৃত হয়েছে এবং হবে। এই প্রসঙ্গে তার সাম্প্রতিক সময়ে তাইওয়ানে একটি কোরিয়ান রেস্তোরাঁয় বারবিকিউ খাওয়ার অভিজ্ঞতার একটি চমৎকার উদাহরণ দেওয়া যাক। সেখানে তিনি যখন খেতে বসলেন বারবিকিউর সঙ্গে লেটুস পাতা বা কোরিয়ান হট সস দেওয়ার কথা বললে মালিক উত্তরে বলেন, ‘‘আমরা তাইওয়ানিরা সাধারণত বারবিকিউয়ের সঙ্গে এসব পরিবেশন করি না।’’ লিয়াং তখন মুচকি হেসে তার বক্তৃতায় বলছেন, ‘‘তাহলে স্থানীয় স্বাদ বজায় রেখে শুধু টাকা উপার্জনের জন্য কোরিয়ান রেস্তোরাঁ খোলার কী দরকার? আপনি যদি ভালো করে পর্যবেক্ষণ করেন তাহলে বুঝতে পারবেন কী কারণে কোরিয়ান রেস্তোরাঁটি খোলা হয়েছে। সেখানে দেখবেন বেশ কিছু কোরিয়ান টিভির পপুলার সোপ অপেরার পোস্টার ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে, যাতে দর্শকের দৃষ্টি পপ-কোরিয়ান ধারার প্রতি আকর্ষণ তৈরি হয়।’’ অনেকটা আমাদের দেশের বড় বিপণিগুলোতে ক্রেতাদের আকর্ষণ করার জন্য যেমন আমরা ভারতীয় ছবির বিভিন্ন বলিউড স্টারদের ছবি ঝুলিয়ে রাখি।
    লিয়াং দুঃখ প্রকাশ করেন তার বিশ বছর বয়স পর্যন্ত ফ্রান্সের নিউ ওয়েভ বা ইতালির নিও রিয়ালিজম বা ফাসবিন্ডারের কোন ছবি দেখা হয়নি। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, সরকার বা স্থানীয় ফিল্ম স্টুডিওগুলো খুব বাছাই করা ছবি নির্মাণ বা আমদানি করত। তারা শুধু ছবির বাজারের দিকে লক্ষ্য রেখে ছবির আমদানি বা নির্মাণ করত। ভালো ছবি দেখার জন্য তাদের কোনো ফেস্টিভ্যালের অপেক্ষা করতে হতো। যদিও পরবর্তীতে এই অবস্থার পরিবর্তন হয়, তবু বেশিরভাগ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোতে হয় শুধু বাণিজ্যিক ছবি চলে না হলে অন্য কোনো ছবি নয়। লিয়াংয়ের বক্তব্যের সঙ্গে আমাদের দেশের সিনেমা শিল্পের অনেক মিল খুঁজে পাই। তবে তাইওয়ানে এই শিল্পের বেশ পরিবর্তন হয়েছে। আশির দশকে মার্শাল ল’ তুলে নেয়ার পর হলিউডের মূল ধারার ছবির আগমন ঘটে, সেন্সরশিপের কড়াকড়ি শিথিল হয় ফলে বেশ স্বাধীনভাবে এখন নির্মাতারা ছবি নির্মাণ করতে পারেন।
   তার ‘ফেস’ ছবি প্রসঙ্গে লিয়াং বেশ কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য আমাদের দেন। যারা ত্রুফোর ‘ফোর হান্ডড্রেড ব্লোউজ’ দেখেছেন তাদের নিশ্চয়ই সেই ছোট্ট বালকটির কথা মনে আছে, সেই বালক পরবর্তীতে যিনি Jean-Pierre Leaud নামে সিনেমা জগতের অভিনয়ে বেশ নাম কুড়িছেন, লুভ মিউজিয়াম যখন তাকে ছবি করার জন্য আর্থিক সহায়তার কথা বলেন এবং জিজ্ঞেস করেন কাকে নিয়ে তিনি ছবি নির্মাণ করতে চান, লিয়াং এক বাক্যে তার নাম বলে ফেলেন। আরো জানান এই লুভ মিউজিয়ামেই তাকে নিয়ে সেই ছবির শুটিং পর্ব পরিচালনা করবেন। কারণ হিসেবে লিয়াং বেশ চমৎকার একটি কথা বলেন, ‘‘জ্যঁ পিয়েরকে মিউজিয়ামেই ঠাঁই দিতে হবে, না হলে খুব দ্রুত তাকে সবাই ভুলে যাবে। কেননা সিনেমার ইতিহাসে তার নাম থেকে গেলেও, ফ্রান্সের বর্তমান বা পরবর্তী প্রজন্ম তাকে ভুলে যাবে। অর্থাৎ আমি খুব সচেতনভাবেই তাকে নিয়ে এভাবে ছবি নির্মাণ করেছি, কেননা সাধারণ এবং এশিয়ান দর্শক ফ্রান্সের নিউ ওয়েভ বা জার্মান নিউ ওয়েভ সম্পর্কে খুব কম জ্ঞান রাখে। ছবিটির মাধ্যমে সেসব ধারার কথা আবার সবার স্মরণে আসবে। অনেকে ছবিটিকে আত্মপ্রতিকৃতি বলে সমালোচনা করেছেন। আমি মূলত জীবন এবং সৃষ্টির মাঝের সম্পর্ক খুঁজে বেড়াবার চেষ্টা করেছি। মানুষ তার বার্ধক্য, জরা, মৃত্যু থেকে রেহাই পেতে পারে না। কিন্তু এসব মেনে নিয়েও বলা যায় জীবন আসলে একটি অনন্ত বৃত্তের, জীবনের ভেতর থেকেই জীবন ফিরে আসে।’’ অসাধারণ দার্শনিক জায়গা থেকে নির্মিত হয়েছে তার সর্বশেষ ছবি ‘ফেস’।
   সিনেমার বাণিজ্যিকীকরণের চরম বিরোধী লিয়াং। তার ভাষায়, ‘‘ফিল্ম শুধু বিনোদনের ক্ষেত্র নয়। জ্যান হাং তেজ যেমন বলেছেন, কোনো বই পড়ার অর্থ নিজেকে বদলে দেওয়া, সিনেমাও ঠিক তাই। এখন মানুষ বই পড়ার চেয়ে সিনেমা দেখে অধিক। কিন্তু প্রশ্ন হলো কোন ধরনের সিনেমা সে দেখে? বেশিরভাগই বাণিজ্যিক ছবি। আমার ‘ফেস’ ছবি দেখে হংকংয়ের একজন দর্শক বলেছেন, ‘যাচ্ছেতাই’ আবার হংকংয়েরই আরেকজন দর্শক বলেছেন, ‘ছবিটি দেখে আমি সারারাত ঘুমাতে পারিনি। প্রতিটি শট বলে দিচ্ছিলো কতটা শ্রম আর কষ্ট দিয়ে তৈরি ছবিটি।’ ছবি দেখা আসলে দু’ঘণ্টা হলে বসে ছবির সঙ্গে ভালোবাসাবাসির বিষয়। এর সঙ্গে বাণিজ্যের কোনো সম্পর্ক নেই। অনেকে মনে করেন ছবি নির্মাণের মাধ্যমে সেই দেশের বিজ্ঞাপনেরও একটা ব্যবস্থা করে। আমি মোটেও তা মনে করি না। তাই আমি যা মনে করি তাই নির্মাণ করি। কে দেখলো আর না দেখলো তার ধার ধারি না। একবার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাকে নিমন্ত্রণ জানানো হয় ছবি বিষয়ে কথা বলার জন্য। সেখানে দর্শকের উদ্দেশ্যে একটা প্রশ্ন রাখা হয় আর তা হলো, ‘ সিনেমার বস কে?’ একটি ছাত্র বললো ‘আমি’। সঙ্গে সঙ্গে আমি প্রতিবাদ করে বললাম, ‘না। ছবি নির্মাণ করি আমি, কাজেই তুমি আমার বস কখনো হতে পারো না। তুমি আমার ছবি দেখতে নাও পার, কিন্তু তুমি কখনোই আমার বস্ হতে পার না, যেমন আমিও পারি না তোমার বস হতে।’
    ত্রুফোর ‘ফোর হান্ড্রেড ব্লোজ’ থেকে একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন লিয়াং। ছবির শেষ দৃশ্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘ছেলেটি যখন বিচে গিয়ে দর্শকের দিকে মুখ ঘোরায় তখনই দর্শক এবং ছবির পর্দা একটি মুখোমুখি অবস্থান নেয়। ছবি তখন দর্শকের সঙ্গে যেন মুখোমুখি কথা বলে ওঠে। সে সমস্যার কথা জানায় কিন্তু কোনো সমাধান দেয় না। ছবিটি আপনাকে কোনো উৎসাহ যোগাবে না, কিন্তু বার বার আপনাকে ধাওয়া করে বেড়াবে। কেন? এখানেই কল্পনার শক্তি লুকিয়ে থাকে। মানুষকে ভাবিয়ে তোলার শক্তিটি লুকিয়ে থাকে। আর আমার ছবিতে এই ভাবিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়।’’ আমরাও লিয়াংয়ের সঙ্গে একমত। যে কোনো শিল্পমন্ডিত ভালো মানের ছবি মানুষকে ভাবিয়ে তোলে। নিজের বা নিজেদের অবয়বে নিজেকে বা নিজেদের দেখতে সহায়তা করে। কোনো ছবি দেখে যদি ভাবতেই না পারলাম, চিন্তা করতে না শিখলাম, নিজেকে বা নিজেদের পরিবর্তন, পরিবর্ধন করতে না পারলাম তাহলে ছবি নির্মাণের সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হতে বাধ্য। সেই ছবি যত মূল্যেই বিক্রীত হোক তাতে কিছু এসে যায় না। এই কল্পনা শক্তির মাঝেই বেঁচে থাকে সিনেমা। আশা করি আমাদের নির্মাতারও লিয়াংয়ের মতো ব্যবসা সফল নয়, ভাবনা সফল ছবি নির্মাণে আরও উদ্যোগী হবেন। তাহলে আমাদের সিনেমাকেও আমরা এভাবেই বেঁচে থাকতে সহায়তা করতে পারব।
             ---ফ্লোরা সরকার

বুধবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১১

মকবুল ফিদা হুসেন এবং হিন্দু মৌলবাদ

যদি প্রশ্ন করা হয় শিল্প কী, তার চেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায় শিল্প কেন? কারণ শিল্প সৃষ্টির একটাই মুখ্য উদ্দেশ্য থাকে আর তা হলো – সুন্দরের সৃষ্টি। আর আমরা সবাই জানি যা আনন্দ প্রদান করে তা-ই সুন্দর। প্রকৃতি সুন্দর বলেই আমাদের তা আনন্দ দান করে। প্রকৃতির সৌন্দর্য প্রদানের মাঝে কোনো কৃত্রিমতা নেই। উন্মুক্ত বা নগ্ন হয়েই সে নিজেকে প্রকাশ করে। প্রকৃতি অকৃত্রিম বলেই সুন্দর এবং সেই প্রকৃত সুন্দরের কারণেই আমরা আনন্দে অবগাহন করতে পারি। খাঁটি শিল্পী তাই প্রকৃতির মতো অকৃত্রিম হতে চায়। তার শিল্পসাধনার একটাই লক্ষ্য থাকে, আর তা হলো সুন্দরের সাধনা। কিন্তু এই সুন্দরের সাধনার পথটি বেছে নেওয়া এতো সহজ কাজ নয়। আর তাই সবাই শিল্পী হতে পারে না। যে কারণে কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছেন – ‘‘কেউ কেউ কবি, সবাই কবি নয়।’’
সুন্দরের পথ বেয়ে শিল্পের নন্দনতত্ত্বে শ্লীল আর অশ্লীলের প্রশ্ন দেখা দেয়। পৃথিবীর অন্যতম বিখ্যাত চিত্রকর পাবলো পিকাসো একজন নারীর সুন্দর নগ্ন শরীরকে শ্লীল বলেই আখ্যায়িত করেছিলেন। যা দেখতে অসুন্দর তা-ই অশ্লীল। তাই ‘নগ্ন’ আর ‘উলঙ্গ’, ইংরেজিতে যাকে ‘ন্যুড’ আর ‘ন্যাকেড’ বলা হয় শব্দ দুটো এক নয়। নগ্নতার মাঝে থাকে সৌন্দর্য, আর উলঙ্গের মাঝে থাকে কদর্য। এই নগ্নতা আর উলঙ্গের মাঝের ভেদরেখা করতে পারেননি বলেই মকবুল ফিদা হুসেনকে ভারতের হিন্দু মৌলবাদী গোষ্ঠী দেশছাড়া হতে বাধ্য করেছিল। যে ফিদা ২০০৬ সাল থেকে বিদেশে অবস্থান করেন এবং বাধ্য হয়ে গত বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি কাতারের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। বিদেশে অবস্থানরত অবস্থাতেই ৮ জুন লন্ডনে হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে পঁচানববই বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। যে ফিদা সুন্দরের অন্বেষণে সারাজীবন তার চিত্রকর্মের কর্মজীবন অতিবাহিত করেন এমন শিল্পীর এরকম করুণ মৃত্যু সত্যি দুঃখজনক।

ফিদার বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হতে শুরু হয় ১৯৯৬ সালে। আমাদের মনে রাখতে হবে এটা হচ্ছে সেই বছর যে বছর ভারতের নির্বাচনের রাজনীতিতে হিন্দু মৌলবাদী শক্তির প্রতিপত্তি বাড়তে থাকে বা উদীয়মান হতে থাকে। ১৯৯৬ সালে ভুপাল থেকে প্রকাশিত মাসিক পত্রিকা ‘বিচার মীমাংসা’য় ওম নাগপালের এক প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল – ‘‘উনি (ফিদা) কি একজন শিল্পী না কসাই?’’ এবং সেই সঙ্গে ১৯৭০ সালে ফিদার অাঁকা সরস্বতী দেবীর নগ্ন চিত্রটির প্রতিরূপ ছাপা হয়। মহারাষ্ট্রের তৎকালীন সংস্কৃতিমন্ত্রী এবং শিবসেনা নেতা প্রমোদ নাভালকার পত্রিকার রিপোর্টের মাধ্যমে ওই প্রবন্ধ সম্পর্কে অবগত হন এবং মূল প্রবন্ধটি পড়ে তা মুম্বাই পুলিশ কমিশনারের কাছে পত্রযোগে বিষয়টি অবগত করান। মুম্বাই পুলিশ সেই পত্রটি অভিযোগ আকারে গ্রহণ করে এবং ১৯৯৬-এর ৮ অক্টোবর, ভারতীয় পেনাল কোড, ধারা ২৯৫-এ (বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরাগ বা ঘৃণার উদ্রেক ইত্যাদি) এবং ধারা ২৯৫ (সুচিন্তিত এবং বিদ্বেষপ্রসূত কাজ যা যে কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অনুভূতির ওপর প্রচন্ড আঘাত হানে)-এর অধীনে ফিদার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। এর পরপরই বজরঙ দল নামের হিন্দু মৌলবাদী রাজনৈতিক দল আহমেদাবাদের হারউইট গ্যালারির বিখ্যাত হুসেন- দোশি গুফা কমপ্লেক্সে হানা দিয়ে হুসেনের চিত্রকর্মগুলো ধ্বংস করে, যার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় এক কোটি পাঁচ লাখ রুপি। হুসেনের প্রায় সব চিত্রকর্ম নষ্ট করা হলো, এমনকি এই ধ্বংসযজ্ঞ থেকে তার সযত্নে অঙ্কিত বৌদ্ধ, হনুমান এবং গণেশের চিত্রকর্ম পর্যন্ত বাদ পড়লো না।

মুম্বাই, দিল্লি এবং আহমেদাবাদের শিল্পীরা হুসেনের সঙ্গে একাত্ম প্রকাশ করে এর প্রতিবাদ জানান। প্রতিবাদকারীরা সুপ্রাচীন হোসেলা মন্দিরের সরস্বতীর বিভিন্ন নগ্ন মূর্তির দৃষ্টান্ত উল্লেখ করেন। তারা বলেন, ভারতীয় চিত্রশিল্পে নগণ দেবদেবী বা নগ্নিকার রূপায়ন ঐতিহ্য বহন করে আসছে। ফিদা সেই ঐতিহ্যকেই বহন করেছেন। লন্ডনে হুসেন একটি বিবৃতি দিয়ে জানালেন,এ চিত্র তিনি কাউকে আঘাত দেয়ার অভিপ্রায়ে অাঁকেননি। তবে তিনি যদি তাই করে থাকেন, সেজন্যে তিনি ক্ষমাপ্রার্থী। শুধু তাই নয়, ফিদা মনে করেন- ‘‘আমার কাজ কাউকে আঘাত দিলে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। কারণ আমি মনে করি মানবতার প্রশ্নটি শিল্পের আগে স্থান পাবার বিষয়। কাজেই আমি কখনো কারোর অনুভূতিতে আঘাত দিতে চাই না।’’ এতোসব সত্ত্বেও হিন্দু মৌলবাদী গোষ্ঠী তাকে রেহাই তো দেয়ইনি, তাকে হত্যার হুমকি পর্যন্ত দিয়ে বসে। ১৯৯৮ সালে নগ্ন সীতাকে হনুমানের লেজের ওপর অঙ্কন করায় আবার তিনি আক্রোশের মুখে পড়েন। ২০০৬ সালে ফিদার অঙ্কিত ‘‘নগ্ন ভারতমাতা’’ চিত্রটির জন্য তাকে পুনরায় অভিযুক্ত করা হয়।  অশোক পান্ডে যিনি হিন্দু ল’ বোর্ডের প্রধান, ফিদাকে মেরে ফেলার জন্যে ১০১ কোটি রুপি প্রদানের ঘোষণা করেন। এভাবে মৃত্যু পরোয়ানা প্রচার হতে থাকে, সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের হামলা। অবশ্য ভারতমাতা ক্যাপশনটি ফিদার দেওয়া ছিল না। এ ক্যাপশন দিয়েছিলেন তার ছবির প্রদর্শকরা।

যাহোক অবশেষে ২০০৮ সালে হাইকোর্টের বিচারপতি সঞ্জয় কিশান কালু তার যুগান্তকারী রায় দেন। সেই রায়ের সারমর্মে যা বলা হয় তা হলো – ফিদার ভারতমাতা চিত্রটি অশ্লীল নয়, নয় কামোদ্দীপক এবং এই চিত্র কোনো বিকৃত কামনার উদ্রেক করে না। চরম দুর্দশাগ্রস্ত একজন নারীর বিমূর্ত চিত্রের মাধ্যমে জাতির একটি অবয়ব দেখাতে চেয়েছেন তিনি। তার চিত্রটির নান্দনিক নগ্নতা, অশ্লীলতাকে বাধাগ্রস্ত করে। চিত্রটি তার মতে কোনো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে না। অতঃপর সুপ্রিমকোর্ট এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল খারিজ করে দেন। কিন্তু আরো তিনটি মামলা তার বিরুদ্ধে জারি থেকে যায় যার একটি ২০০৯ সালে খারিজ হয়ে যায় এবং বাকি দুটি ঝুলে থাকে- সঙ্গে তার চিত্রকর্মের বিরুদ্ধে বর্বরের ন্যায় বিধ্বংসীকারীর ভয়াবহ ভীতি প্রদর্শন অব্যাহত রয়ে যায়। গত বছর তাই ফিদার অ্যাডভোকেট আকিল সিবাল বলেন- ‘‘ভারত সরকার ১৫ বছর ধরে হুসেনের হয়রানির ক্ষেত্রে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে এসেছে। তারা না কোনো স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে, না হুসেনের পক্ষে দ্ব্যর্থহীন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সরকার যেন এভাবে হুসেনের জামিনরূপে না থাকে এবং ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের উচ্চ ও তীক্ষ্ণস্বরের বিপরীতে অবশ হয়ে না থাকে।’’ তারপরও সবার নীরবতার ভেতর দিয়েই ফিদাকে ভারত থেকে অনেক দূর অবস্থানে চির বিদায় নিতে হলো।

মকবুল হুসেন ফিদা যিনি মহারাষ্ট্রের পাহাড়পুরে ১৯১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর জন্মেছিলেন। তার বাবা  সেখানকার একটি কারখানার শ্রমিকদের কার্যকালের হিসাবরক্ষক পদে কর্মরত ছিলেন। কলেজের গন্ডি পার হয়ে ১৭ বছর বয়সে দর্জির কাজে শিক্ষানবিশী করেন ফিদা। ১৯৩৭ সালে মুম্বাই চলে আসার পর প্রথমে চলচ্চিত্রে অভিনয় করার বাসনা থাকলেও চিত্রকর্মেই মনোনিবেশ করেন। সেখানে তিনি বিলবোর্ড স্থাপনের সহকারী হিসেবে কাজসহ সাইনবোর্ডের চিত্রশিল্পী হিসেবেও কাজ করেন। তাছাড়া আসবাব এবং খেলনার কারিগর হিসেবেও বেশ কিছুদিন কাজ করেন। এর পাশাপাশি চিত্রকর্মের কাজ চালিয়ে যান। ১৯৫২ সালে তার প্রথম একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় বোম্বেতে এবং পরবর্তীতে প্রথম আন্তর্জাতিক শিল্প প্রদর্শনী হয় জুরিখে।

তিনি ১৯৫৫ সালে পদ্মশ্রী, ১৯৭৬-এ পদ্মভূষণ এবং ১৯৯১-এ পদ্মবিভূষণ খেতাবে ভূষিত হন। এছাড়া ১৯৭১-এ ব্রাজিলের সাওপাওলোতে অনুষ্ঠিত দ্বিবার্ষিক শিল্প প্রদর্শনীতে পাবলো পিকাসোর সঙ্গে বিশেষ আমন্ত্রিত অতিথি শিল্পী হিসেবে যোগ দিয়ে ভারতের মুখ উজ্জ্বল করেন। শিশুবয়সে মাতৃহীন ফিদাকে আজীবন ‘নারী’র প্রতি এক অসীম সম্মান প্রদর্শন করতে দেখা যায়, নারীকে তাই তিনি শ্রদ্ধার সঙ্গে তার চিত্রকর্মে ঠাঁই করে দিয়েছিলেন। যে কারণে মাদার তেরেসার ওপর তার সিরিজ চিত্রকর্মে তেরেসার কোন মুখাবয়ব দেখা না গেলেও নীল পাড়ের সাদা শাড়ি পরিহিত নারীটিকে আমাদের মাদার তেরেসা বলে শনাক্ত করতে কোন ভুল হয় না। সেই সম্মান থেকেই তিনি ২০০০ সালে নির্মাণ করেন মাধুরি দীক্ষিত অভিনীত ‘গজগামিনী’ চলচ্চিত্র এবং ২০০৪ সালে নির্মাণ করেন টাবু অভিনীত ‘মিনাক্ষী’ চলচ্চিত্র। ১৯৬০ সালে ভারতের চলচ্চিত্র বিভাগ তাকে স্বল্প দৈর্ঘের একটি ছবি নির্মাণের অনুমতি প্রদান করলে তিনি নির্মাণ করেন ‘‘Through the eyes of a painter’’। যে ছবিটি বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে ‘গোল্ডেন বিয়ার’ পুরস্কারে ভূষিত হয়।

প্রয়াত শান্তি চৌধুরী যিনি ১৯৬০-৭০ দশকের একজন স্বনামধন্য তথ্যচিত্রনির্মাতা হিসেবে খ্যাত, ফিদার ওপর তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন। যে ছবিতে আমরা ফিদার মহাভারত এবং রামায়ণের প্রতি প্রগাঢ় মনযোগের পরিচয় পাই। ছবিটিতে শান্তি দেখিয়েছেন ফিদার চিত্রকর্মের বেশিরভাগ কাজ মহাভারত এবং হিন্দু মিথ থেকে গ্রহণ করা। ফিদা বিশ্বাস করতেন ধর্মীয় অভিগমন সাংস্কৃতিক প্রতিফলনে তার প্রকাশ ঘটে। সাধারণ মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসের ওপর তার প্রগাঢ় শ্রদ্ধাবোধ ছিল এবং এই বিশ্বাস সমাজের প্রগতির দিকে ধাবিত করে বলেই তিনি মনে করতেন।

যে শিল্পী তার শিল্পকর্মে সত্যনিষ্ঠ হতে চায় তাকে প্রথমে নিজের কাছে সত্যনিষ্ঠ হতে হয় আর ফিদা ছিলেন এই দুই সমন্বয়ের সংশ্লেষণ। অত্যন্ত সাধারণ জীবনযাপনে বিশ্বাসী এই শিল্পী কোন দামি রেস্তোরাঁর চেয়ে রাস্তার ধারের দোকানের চা-ই বেশি পছন্দ করতেন। এই সাধারণত্বের কারণেই  তিনি তার শিল্পকর্মে ভারতের প্রাচীন ঐতিহ্য তথা মূল সংস্কৃতির সন্ধানে রত ছিলেন। তার এই বিশ্বাসের জায়গা থেকে ’৯৬-এ আহমেদাবাদ গ্যালারিতে তার চিত্রকর্মের ওপর আক্রমণের পর তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন- ‘‘আন্তর্জাতিক শিল্পী হতে হলে নিজের শেকড়কে কখনো অস্বীকার করা যায় না। …আমি ভারতের একটি অংশ, আমার আছে ৫০০০ বছরের সংস্কৃতি এবং ভারতে জন্মে আমি নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে করি।’’ তার মৃত্যুর পর স্বভাবতই এখন প্রশ্ন জাগবে, তিনি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করলেও ভারত তার প্রতিদানে তাকে কতটুকু ভাগ্যবান মনে করে বা করবে? কারণ ফিদার মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন যে শিল্পীকে নিজের দেশে বিড়ম্বনার কারণে শেষ বয়সে অন্য দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করতে হয়, মৃত্যুর পরও কি সেই শিল্পী সেই দেশের (কাতার) নাগরিক হয়েই থাকবেন?

সুনীল শেঠি, ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে তার প্রবন্ধ ‘A Portrait of India’s Intolerance’-এ তাই লিখেছেন, ‘‘ভারত হয়তো এখন হুসেনকে তার দেশের সন্তান হিসেবে দাবি করবে। কেউ কেউ তার নামে ডাকটিকিট ছাপাবে। অন্যরা তার নামে রাস্তা বা গ্যালারির নামকরণ করবে…।’’ এসবের পরেও ভারতের শিল্পকলার ইতিহাসে ফিদার উদাহরণ একটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। যে দৃষ্টান্ত অন্য শিল্পীদেরও ভাবিয়ে তুলছে। মুম্বাই থেকে অনুপমা কাটানাম তার একটি হ্যান্ডআউট (M.F. Hussain remained a victim of attacks and hate campaingns by Hindutva groups in the last 15 years) এ লিখেছেন- ‘‘…ফিদার চলে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে ‘শিল্পের স্বাধীনতা’র প্রশ্নটি আবার নবরূপে দেখা দিয়েছে এবং সেই সঙ্গে রাষ্ট্রের মৌলিক অধিকার রক্ষার ব্যর্থতার প্রশ্নটিও উত্থাপিত হচ্ছে। হিন্দু মৌলবাদী গোষ্ঠীর পরমত অসহিষ্ণুতার প্রথম শিকার চিত্রকর হুসেন। যথেষ্ট ক্ষতি তার করা হয়েছে। অনেক শিল্পী এখন সৃষ্টিশীল কাজ করতে ভয় পাচ্ছেন। হুসেনের পথে যেতে এখন সবাই ভয় পাচ্ছেন…।’’সেজন্যই সুন্দরের সাধনা দিয়ে প্রবন্ধটি শুরু করা হয়েছিল। শিল্পের কাজ সুন্দরের সাধনা অর্থাৎ আনন্দ প্রদান, রাষ্ট্র বা কোনো ক্ষুদ্র গোষ্ঠী তার বা তাদের নিষেধাজ্ঞা দিয়ে কোনো শিল্পের কাজ বন্ধ করে দিলে তাতে  সেই রাষ্ট্রেরই শুধু ক্ষতি হয় না, সেই সঙ্গে গোটা মানবসমাজেরও ক্ষতি হয়। আমরা কোনো দেশের জন্যই সেই ক্ষতি ভবিষ্যতে দেখতে চাই না।
ফ্লোরা সরকার

মঙ্গলবার, ২৩ আগস্ট, ২০১১

তারেক মাসুদ-মিশুক মুনীর : এই অকাল মৃত্যু অনিবার্য নয়

বাংলাদেশ শুধু আর্থিক দিক থেকে নয়, বুদ্ধিজীবিতার দিক থেকেও দরিদ্র। এখানে শিক্ষিতের হার শুধু স্বল্প নয়, উচ্চশিক্ষিতের হার আরো স্বল্প। শিল্প ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এই দারিদ্রে্যর চেহারা আরো প্রকট। বিশেষত চলচ্চিত্র শিল্পে হাতে গোনা কয়েকজন চিত্র পরিচালকের দেখা-সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে সত্তরের দশকে যখন আমাদের চলচ্চিত্র শিল্প মাত্র মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শুরু করেছে তখন আমরা জহির রায়হানের মতো চিত্র পরিচালককে অকালে হারাই। আশির দশকে এদেশের চলচ্চিত্র যখন নান্দনিক, বস্ত্তনিষ্ঠ ও সুস্থধারার চলচ্চিত্রের মুখ দেখতে শুরু করে আলমগীর কবীর, কবীর আনোয়ার, সালাউদ্দিন জাকি, মশিউদ্দিন শাকেরের মতো উঁচুমাপের নির্মাতাদের হাত ধরে, ঠিক সেই সময়ে আমরা হারাই আলমগীর কবীরকে। আলমগীর কবীরের হাত ধরে সেই সময়ে কিছু তরুণ চলচ্চিত্র শিল্পে এগিয়ে আসেন যারা পরবর্তীতে আমাদের চলচ্চিত্রে অসামান্য অবদান রাখেন। তারেক মাসুদ ছিলেন সেই বিরল প্রতিভাবানদের একজন। চলচ্চিত্র যার কাছে ছিল স্বপ্ন এবং বাস্তব, দু-ই। চলচ্চিত্র শিল্পে নির্মাতাদের পাশাপাশি আমাদের এখানে সিনেমেটোগ্রাফার বা দক্ষ চিত্রগ্রাহক খুব বেশি নেই। শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর পুত্র মিশুক মুনীর যার পুরো নাম আশফাক মুনীর চৌধুরী ছিলেন সেই বিরল চিত্রগ্রাহকদের একজন। গত ১৩ আগস্ট মানিকগঞ্জের ঘিওরে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় তারেক মাসুদ এবং মিশুক মুনীরের অকাল প্রয়াণ ঘটে। কাকতালীয় হলেও আলমগীর-কবীরেরও প্রয়ান ঘটে গাড়ি দুর্ঘটনায়। তিনি মারা যান ফেরীতে উঠতে গিয়ে গাড়িসহ সলিল সমাধি হয়ে।
বর্তমান এই সময়ে আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পের প্রকট দুর্দিন চলছে। অনেক সিনেমা হল ইতোমধ্যে মার্কেটে রূপান্তরিত হয়ে বন্ধ হয়ে গেছে। আরো বেশকিছু হল বন্ধ হওয়ার প্রহর গুনছে। দেশে ভালো ছবির অভাবে বিদেশ বিশেষত ভারত থেকে ছবি আমদানির ব্যবস্থা সম্পন্ন হয়ে গেছে। আগামী ঈদ থেকে আমাদের সিনেমা হলগুলোতে এসব ছবির প্রদর্শনী শুরু হওয়ার কথা। চলচ্চিত্র শিল্পের এই দুর্যোগকালে এই দুজন প্রতিভাবানের অকাল প্রয়াণ আমাদের জন্য কতটা ‘অপূরণীয় ক্ষতি’ তা বিশেষ কোনো ব্যাখ্যার দাবি রাখে না। ক্ষতিটা ‘অপূরণ’-যোগ্য, কারণ বিরল প্রতিভার আগমন খুব সহজে ঘটে না।
তাদের কর্মময় জীবনের সংক্ষিপ্তসার : আশির দশকে আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পে ‘বিকল্পধারা’ আন্দোলনে যারা প্রথম পদক্ষেপ গ্রহণ করেন নির্মাতা তারেক মাসুদ ছিলেন তাদের পুরোধাদের একজন। এখানে একটি কথা বিশেষভাবে পরিষ্কার করে নেওয়া প্রয়োজন আর তা হলো, আমাদের বিকল্পধারার চলচ্চিত্র কখনো মূল বা প্রচলিত ধারার চলচ্চিত্রের (এফডিসিকেন্দ্রিক প্রযোজকদের পুঁজি ও সেখানকার কারিগরি সুবিধা ব্যবহার করে এবং এই ধারায় প্রতিষ্ঠিত অভিনেতা এবং তারকাদের নিয়ে যেসব ছবি নির্মিত হয়) প্রতিপক্ষ ছিল না। যে কারণে তারেক মাসুদ কখনোই বিকল্পধারা এবং বাণিজ্যিক ধারায় চলচ্চিত্রকে বিভাজিত করেননি। প্রাতিষ্ঠানিক সিনেমার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের উদ্দেশ্যে সিনেমা জগতে যে বিকল্পধারা ‘দ্য নিউ আমেরিকান সিনেমা’য় দেখা যায়, আমাদের বিকল্পধারা তার থেকে বেশ ভিন্ন। মূলত ১৬ মিলিমিটার ফরম্যাটকে ৩৫ মিলিমিটার ফরম্যাটের বিকল্প বা সমান্তরাল সিনেমা হিসেবে উপস্থাপন, স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সমস্যাবলীর সমাধান, স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র প্রদর্শনের বিকল্প নেটওয়ার্ক নির্মাণ, স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের নির্মাণ ও প্রদর্শন প্রক্রিয়ার গণমুখী এবং প্রগতিশীল চরিত্র সংরক্ষণ, তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য দেশে যেসব বিকল্প চলচ্চিত্র আন্দোলনসমূহ রয়েছে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ ও একাত্মতা, সর্বপ্রকার সামাজিক অবিচারবিরোধী সংগ্রাম এবং মৌলবাদবিরোধী ও গণতান্ত্রিক সংগ্রামের সঙ্গে একাত্মতা – এসব উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই আমাদের এখানে বিকল্পধারার আন্দোলনের সূচনা ঘটে। যেজন্য তারেক মাসুদকে আমরা দেখি শহর থেকে গ্রামে আমাদের চলচ্চিত্রকে নিয়ে যাননি বরং গ্রাম থেকে চলচ্চিত্রকে তিনি শহরে নিয়ে আসেন।
কোনো ছবি নির্মিত হওয়ার পর, তা শুধু শহরের প্রেক্ষাগৃহে বন্দি হয়ে থাকেনি, ছবি নিয়ে তিনি ছুটে গেছেন প্রত্যন্ত এলাকায়। আবার ঠিক একইভাবে তা চলে গেছে দেশের বাইরের সব প্রেক্ষাগৃহে। আমাদের চলচ্চিত্রকে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে বিস্তার ঘটানোই ছিল তার উদ্দেশ্য। তিনি বিশ্বাস করতেন দশটা বিবৃতি বা বক্তৃতায় যা হয় না তা একটিমাত্র চলচ্চিত্র দিয়ে হতে পারে। আর তাই সারাজীবন তিনি নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন একজন সৎ, কর্মনিষ্ঠ এবং সফল চিত্রনির্মাতা হিসেবে। ‘সোনার বেরি’ (১৯৮৫) দিয়ে তার চলচ্চিত্রের আবির্ভাব ঘটলেও ‘মুক্তির গান’ (১৯৯৫) এবং ‘মাটির ময়না’ (২০০২)র মধ্যে দিয়ে তার দক্ষতা ও জনপ্রিয়তার যাত্রা শুরু হয়। মুক্তির গানকে ১৯৯৭ সালে ফিল্ম সাউথ এশিয়া থেকে বিশেষ সম্মাননা দেওয়া হয়। যৌথভাবে তারেক মাসুদ এবং তার স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ পরিচালিত ডকুমেন্টারি ছবিটি ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রের একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় দলিল হিসেবে আমাদের মাঝে থাকবে। ছবিটির ফুটেজ মার্কিন চলচ্চিত্রকার লিয়ার লেভিন, যিনি ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর একটি ডকুমেন্টারি নির্মাণের লক্ষ্যে সংগ্রহ করেন এবং পরবর্তীতে আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে শেষ করতে পারেননি, মাসুদ তার কাছ থেকে সেসব ফুটেজ এবং বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত উপাদান যোগ করে নির্মাণ করেন ছবিটি।
মুক্তির গানের পর ‘মুক্তির কথা’ নির্মাণ করেন ১৯৯৬-এ, যে ছবি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আরেকটি প্রামাণ্যচিত্র। ‘মাটির ময়না’ ষাটের দশকের উত্তাল সময়ের প্রেক্ষাপটে নির্মিত কাহিনী চিত্র যার সমাপ্তি ঘটে মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভে। দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পাশাপাশি আনুর মাদ্রাসার চরম ও মধ্যপন্থী মতবাদের বিকাশ এবং সেইসঙ্গে আনুর বাবা-মায়ের ধর্মীয় গোঁড়ামি ও স্বাধীনতার চেতনার চিত্রের সমান্তরাল ছবি চমৎকার করে ফুটিয়ে তোলেন। আমাদের ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে পরিচালক মাত্র দুটি সংলাপের মাধ্যমে দর্শককে বুঝিয়ে দেন, ভাষার বিষয়ে আমাদের মূল বিরোধ আরবি নয় উর্দুর সঙ্গে ছিল। একটি দৃশ্যে আমরা দেখি আনুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু, যে চরিত্রটি ছবির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রও বটে, তাকে মাদ্রাসার শিক্ষক জিজ্ঞেস করছেন সে উর্দুতে এত কাঁচা কেন, ছেলেটি উত্তরে বলে, উর্দুর চেয়ে তার আরবি পড়তে বেশি ভালো লাগে। এভাবে পরিচালক আমাদের বিরোধের জায়গাটা স্পষ্ট করে দেন। ছবিটি ২০০২ সালে কান ফিল্ম ফেস্টিভালে ক্রিটিক অ্যাওয়ার্ড ও ডিরেক্টর ফর ফোর্টনাইট পুরস্কারে ভূষিত হয়। একই বছরে এডিনবার্গ ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভালসহ আরো অনেক ফেস্টিভালে দেখানো হয় এবং পুরস্কৃত হয়।
২০০৬-এ মুক্তিপ্রাপ্ত ‘অন্তর্যাত্রা’য় আমরা দেখি, স্বদেশভূমে শেকড়ের সন্ধানে আসা মা ও ছেলের এই যাত্রা তাদের অন্তর্যাত্রা হয়ে যায় কীভাবে। তার অপর একটি প্রামাণ্যচিত্র ‘আদম সুরত’। যে ছবি আমাদের বরেণ্য চিত্রকর এস এম সুলতানকে নিয়ে চিত্রিত, সেই ছবি দেখে সুলতান এতটাই আনন্দিত হয়েছিলেন যে তিনি পরিচালককে বলতে বাধ্য হন – ‘সাধারণভাবে বিখ্যাত মানুষের তথ্য বা প্রামাণ্যচিত্র দিয়ে পরিচালক বিখ্যাত হন আর এই ছবিতে ঠিক উল্টোটা হয়েছে।’ অর্থাৎ তারেক মাসুদের মাধ্যমে সুলতান বিখ্যাত হন। প্রকৃতপক্ষে একজন প্রতিভাধর অপর একজন প্রতিভাধরকে শনাক্ত করতে কখনো ভুল করেন না, পরিচালকেরও তাই ভুল হয়নি চিত্রকরকে শনাক্ত করতে।
তারেক মাসুদের কাজের ভেতর সব থেকে যে বড় অংশটি জুড়ে ছিল তা হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিষয়টি। আর দশজন সাধারণ মানুষের থেকে তার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ভিন্ন। তার কাছে ১৯৭১ সালে বাস্তবে কী ঘটেছে তার থেকে অনেক বড় বিষয় ছিল কে কোন পারসেপশন বা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মুক্তিযুদ্ধকে দেখে। কেননা, দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই যে কোনো আখ্যান-উপাখ্যান গড়ে ওঠে। তার একটি লেখা ‘মুক্তিযুদ্ধের বিতর্কিত ছবি’তে তিনি লিখেছেন ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একটি প্রধান অংশ হলো, মানুষ মানুষকে মেরেছে। কিন্তু এটাও পরম সত্য, একাত্তরে মানুষ মানুষকে বাঁচিয়েছে। একজন বিহারিকে বাঙালি বাঁচিয়েছে, একজন বাঙালিকে বিহারি বাঁচিয়েছে। একজন বাঙালি একজন নিরস্ত্র বন্দি পাকিস্তানি সৈন্যকে বাঁচিয়েছে। একজন পাকিস্তানি একজন বাঙালিকে বাঁচিয়েছে। এই বহুমাত্রিক দিকটি কিন্তু সাধারণত আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রে প্রথম পর্যায়ে খুব একটা দেখি না।’ দেখার এই বহুমাত্রিকতা আমরা খুব কম চিত্রনির্মাতার মাঝে পাই। আর তাই তার পরবর্তী ছবি ‘নরসুন্দর’ (২০০৯) মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি হওয়া সত্ত্বেও, ছবিতে দেখি আবাঙালি হয়েও মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালিদের পাশে এসে দাঁড়ায় সেই নরসুন্দর। ছবির নামের সঙ্গেও চমৎকার সামঞ্জ্যতা পাই কাহিনীর। ‘রানওয়ে’ (ছবিটির প্রিমিয়ার হয় ২ অক্টোবর, ২০১০) ছবিটি সাম্প্রতিক সময়ের সমাজবাস্তবতাকে কেন্দ্র করে নির্মিত। এই সমাজের প্রান্তিক মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রামকে কেন্দ্র করে আবর্তিত এর বিষয়বস্ত্ত। যার অসাধারণ চিত্রগ্রহণ আমরা পাই মিশুক মুনীরের মুন্সিয়ানায়।
পিতার উপযুক্ত সন্তান হিসেবেই আবির্ভূত হয়েছিলেন মিশুক মুনীর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে পড়াশোনা শেষ করে সেখানেই শিক্ষকতা করেন কিছুদিন। তবে পেশাগত জীবনে শিক্ষকতার চেয়ে ক্যামেরা হাতে নিয়ে কাজ করতেই বেশি ভালোবাসতেন। ক্যামেরার ভাষায় কথা বলতে বেশি পছন্দ করতেন। দেশে যখন ইলেট্রনিক্স মিডিয়ার বিকাশ ঘটেনি তখনো তিনি ক্যামেরা হাতে ছুটে বেড়িয়েছেন দেশের বাইরে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন চ্যানেলের হয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছেন দেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমগুলোর জন্য।
একুশে টিভির যাত্রারম্ভে মিশুক মুনীর দায়িত্ব পান সংবাদ বিভাগ পরিচালনার। হলিউডসহ কানাডার রিয়ের নিউজ নেটওয়ার্কের মতো জায়গায় কাজ করা সত্ত্বেও দেশের টানে ফিরে এসে যোগদান করেন এটিএন নিউজে। কর্মপাগল মানুষটি শুধু খবরের সীমানায় নিজেকে আবদ্ধ রাখেননি। ক্যামেরা হাতে ছুটে গেছেন বিভিন্ন ছবি নির্মাণের কাজে। তারেক মাসুদের ছবিতে আমরা পাই তার অনবদ্য ক্যামেরার কাজ। দুজন যেন মানিকজোড় হয়ে কাজ করেছেন ছবির ক্ষেত্রে। তারেক মাসুদের নরসুন্দর এবং রানওয়ে ছবির চিত্রগ্রহণ দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বাদ অথচ পরিপূর্ণ আনন্দ প্রদান করে দর্শকদের। তারেক মাসুদের সর্বশেষ ছবি ‘রানওয়ে’তে ক্যামেরা যেন জীবন্ত হয়ে ধরা দেয় দর্শকের কাছে। মনে হয় রানওয়েতে বসে খুব কাছে থেকে আমরা বিমান উড়তে দেখি, যে বিমান অন্যতম একটি প্রতীক হয়ে দেখা দেয় ছবিতে।
নতুন নতুন উদ্ভাবনের নেশায় মেতে থাকতেন এই দক্ষ মানুষটি (মিশুক-মুনীর)। বন্যপশু সংরক্ষণে ছিল তার প্রগাঢ় আগ্রহ। পশুর প্রতি এই অসীম ভালোবাসা, যা খুব বিরল আমাদের মাঝে। ক্যামেরার পশ্চাতে যারা থাকেন তাদের পরিচয় আমরা খুব একটা পাই না। তাছাড়া মিশুক মুনীর ছিলেন প্রচারবিমুখ একজন মানুষ। সত্যিকার কাজে যারা নিজেদের নিয়োজিত রাখেন প্রচারের প্রচারণা তাদের কখনো প্ররোচিত করে না। আর তাই তার মৃত্যুর পরই শুধু তার কর্মসফল জীবনের পরিচয় আমরা পেলাম। একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে তার মৃত্যুর পর একটি আলোচনার টেবিলে সম্পাদক আবেদ খান তার সম্পর্কে চমৎকার একটি কথা আমাদের জানালেন- ‘একদিন আমি মিশুককে বললাম, এত রাত পর্যন্ত কাজ করছ, তুমি কি বাড়ি যাবে না? মিশুক উত্তরে বললেন- ‘আমি তো বাড়িতেই আছি’। যে মানুষ কর্মস্থল এবং গৃহস্থলের মাঝে কোনো বিভেদ টানেন না, তিনি কত বড় কর্মী হতে পারেন তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু এতবড় কর্মীকে আমরা হারালাম। আমরা বুঝতে পারলাম বাংলাদেশ কত শক্তিমান একজন প্রতিভাধর চিত্রগ্রাহককে হারাল। এই হারানোর বেদনার ভাষা প্রকাশের ক্ষমতা আমাদের নেই। শুধু এইটুকু উপলব্ধি করতে পারি মিশুক মুনীর, তারেক মাসুদের মতো বিরল প্রতিভা এদেশে আমরা খুব একটা পাই না। হয়তো ভবিষ্যত প্রজন্মে আমরা পাব। কিন্তু এরকম প্রতিভার সন্ধান পেতে আমাদের অনেক অনেক দিন অপেক্ষা করতে হবে।
শুরু করেছিলাম দারিদ্র্য দিয়ে। আমাদের বিত্তের দারিদ্র্য যাই থাক, আমাদের চিত্তের দরিদ্রতা যেন আমাদের গ্রাস না করে ফেলে। বিশেষত মিডিয়ার মতো শক্তিশালী একটি মাধ্যম, যে মাধ্যম একমুহূর্তে অনেক মানুষের কাছে চলে যেতে পারে সেরকম জায়গায় তাদের মতো মানুষ এখন আমাদের খুব প্রয়োজন। তাদের প্রতি শুধু শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে আমরা যেন আমাদের দায়িত্ব শেষ করে না দেই। তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীরের মতো মানুষের পদাঙ্ক অনুসরণ করাই হবে তাদের প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা প্রদর্শন। তারা তাদের কাজের মাঝে যে নিষ্ঠা, সততা, শ্রম আর কর্মদক্ষতা আমাদের দেখিয়েছেন তা ভুলে গেলে তাদেরও অসম্মান করা হবে। বিশেষত চলচ্চিত্র, নাটকের এই দুর্যোগের সময়ে তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীরের মতো মানুষের কত প্রয়োজন চলচ্চিত্র এবং মিডিয়া কর্মীরা তা উপলব্ধি করতে পারবেন সব থেকে অধিক। আমরা আশা করব, আলমগীর কবীর, তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীরের মতো প্রতিভাবানরা যেন এভাবে অকালে চলে না যান। যে মৃত্যু তারেক মাসুদকে তার দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্নের ছবি ‘কাগজের ফুল’কে আর ফুটতে দিল না। মৃত্যু অনিবার্য, কিন্তু অকাল মৃত্যু অনিবার্য নয়। যে মৃত্যু মানুষের হাতে তা হতে দেওয়া যায় না। আর তাই সড়ক দুর্ঘটনা নয়, সড়ক সন্ত্রাসে যেন আর কোনো হত্যা সংঘটিত না হয়।
ফ্লোরা সরকার

রবিবার, ২৪ জুলাই, ২০১১

নিষিদ্ধ নির্মাতা জাফর পানাহী

কেনিয়ার বিশিষ্ট লেখক গুগি ওয়াং থিয়ংও তার বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘শিল্পী ও রাষ্ট্র : সম্পর্কের টানাপোড়েন’-এ লিখেছেন – ‘‘যখন শিল্পী আর রাষ্ট্রের মধ্যে সংঘাত শিল্পভূমির ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা নিয়ে, তখন বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা বিশ্লেষকের, ব্যাখ্যাকারের। রাষ্ট্র, স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র বাধা দেয় শিল্পকে, মানুষকে ক্ষমতাবান করে তোলে যে শিল্প তাকে। যখন রাষ্ট্র শিল্পের সঙ্গে সখ্য তৈরি করার চেষ্টা করে, তৈরি করতে পারে, সেখানেও সেই সখ্যের বিশ্বাসযোগ্যতাকেই রাষ্ট্র সন্দেহ করে।…শিল্পের কাছে উত্তরের চেয়ে প্রশ্নের সংখ্যা বেশি। শিল্প শুরু করে না-জানার জায়গা থেকে, জানতে চাওয়া থেকে। শিল্পের কাছে কোনো উত্তর নেই। প্রশ্নের মধ্যেই উত্তর জড়িয়ে থাকে। তা ইঙ্গিত, সম্ভাবনা, নিশ্চয়তা নয়। পক্ষান্তরে রাষ্ট্রের কাছে অনেক উত্তর এবং প্রায় কোনো প্রশ্নই নেই। রাষ্ট্র যত স্বেচ্ছাচারী হবে, তত নিজেকে কম প্রশ্ন করবে। তত কম অন্যের প্রশ্নকে শুনতে চাইবে।’’ রাষ্ট্রের কাছে প্রশ্ন নেই বলে রাষ্ট্র প্রশ্নবিদ্ধ হবে না তা কিন্তু নয়। শিল্পের কাজে যখনই বাধা এসেছে তখনই শিল্পীরা প্রতিবাদের ভাষা নিয়ে এগিয়ে এসেছে।
২০ ডিসেম্বর ২০১০-এ ইরানের অন্যতম বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা জাফর পানাহীকে যখন ইরান সরকার ছয় বছরের জেল এবং বিশ বছরের জন্য চলচ্চিত্র নির্মাণ নিষিদ্ধ করে দেয় তখন বিশ্বব্যাপী নিন্দা, প্রতিবাদ ও প্রশ্নের ঝড় ওঠে। যা অব্যাহত গতিতে এখনো চলছে। শুধু তাই না, পানাহীর অন্যতম সহযোগী চলচ্চিত্র নির্মাতা মোহাম্মদ রসোলফকেও সাজা দেওয়া হয়। এবারের বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে পানাহীর সম্মানে তার ছবির প্রদর্শনী এবং এই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে বিশেষ আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। পানাহীকে এবারের ফেস্টিভ্যালে গোল্ডেন বিয়ার শাখার জুরি হিসেবেও মনোনীত করা হয়। ২০০৬ সালে এই ফেস্টিভ্যালেই তার ‘অফ সাইড’ ছবিটি সিলভার বিয়ার (জুরি গ্র্যান্ড প্রাইজ) পুরস্কারে ভূষিত হয়। কিন্তু জেলে থাকার কারণে এবারের ফেস্টিভ্যালে যাওয়া হয়নি তার। এবারের কান চলচ্চিত্র উৎসবেও (ফ্রান্স) পানাহী এবং মোহাম্মদ রাসোলফকে বিশেষভাবে সম্মানিত করা হয়। রাসোলোফের ‘গুডবাই’ এবং পানাহীর ‘দিস ইজ নট এ ফিল্ম’ ছবি দুটি এবারের কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়। উৎসবে পানাহীর নিষেধাজ্ঞা বিষয়ে নিন্দা জ্ঞাপন করা হয়। ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১১ নিউইয়র্ক শাখার এশিয়াটিক সোসাইটি পানাহীর নিষেধাজ্ঞা নিয়ে বিশেষ আলোচনার আয়োজন করে। সেই সঙ্গে মোহাম্মদ রাসোলফ পরিচালিত এবং পানাহীর সম্পাদিত ছবি ‘দ্য হোয়াইট মিডোজ’ ছবিসহ পানাহীর আরো দুটি ছবি ‘ক্রিমসান গোল্ড’ এবং ‘দ্য সার্কল’-এর প্রদর্শনীর আয়োজন করে সোসাইটি। সেই আলোচনার বিস্তারিত এবং ছবি নির্মাণের ক্ষেত্রে পানাহীর নিজস্ব দৃষ্টিকোণ নিয়ে আলোচনার আগে দেখা যাক কী কারণে ইরান সরকার তাকে এবং মোহাম্মদ রাসোলফকে বিভিন্ন দন্ডে সাজাপ্রাপ্ত করেছেন।
পানাহীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ শুরু হয়েছিল বেশ আগে থেকেই। ২০০৯-এর ৩০ জুলাই তাকে প্রথমবারের মতো গ্রেফতার করা হয়। ২০০০-এ নির্মিত ‘দ্য সার্কল’ এবং ২০০৬-এ নির্মিত ‘অফ সাইড’ ছবিসহ আরো অনেক ছবি ইরানের বাইরে পুরস্কৃত হলেও ওই ছবি দুটিসহ তার অন্যান্য ছবি নিয়ে সরকারের ভেতর সমালোচনা শুরু হয়ে যায়। প্রথমবার গ্রেফতারের পর তাকে ছেড়ে দেওয়া হলেও তার পাসপোর্ট কেড়ে নেওয়া হয় এবং দেশ ছাড়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। ২০১০-এর ফেব্রুয়ারিতে ষাটতম বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে তার যোগদানের কথা ছিল এবং ছবির আলোচনা পর্বে পানাহীর আলোচনা করারও কথা ছিল যার শিরোনাম – ‘ইরানি ছবি : বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ; প্রত্যাশা ইরানের ভেতরে এবং বাইরে’ – কিন্তু ইরান সরকার তাকে সেই উৎসবে যোগদান করতে দেয়নি। ১ মার্চ, ২০১০ পানাহীকে আবার গ্রেফতার করা হয়। তাকে তার স্ত্রী, কন্যাসহ তার বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে এভিন কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই গ্রেফতারের সময় তার ১৫ জন বন্ধুকেও গ্রেফতার করা হয়। পরে ৪৮ ঘণ্টার মাথায় তাকে ছাড়া আর সবাইকে ছেড়ে দেওয়া হয়। পানাহীর গ্রেফতারি পরোয়ানা সরকার নিশ্চিত করলেও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তখনো নিশ্চিত করা হয়নি। শেষে ২০ ডিসেম্বর, ২০১০-এ গ্রিন মুভমেন্টে যোগদানের অভিযোগে তার জেল এবং ছবি নির্মাণের ওপর নিষেধাজ্ঞার আদেশ জারি করা হয়। বর্তমানে এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের শুনানি চলছে।
১৯৬০ সালে ইরানের মাইনেহ প্রদেশে জাফর পানাহীর জন্ম। মাত্র ১০ বছর বয়সে তার লেখা প্রথম বইটি লিটারেরি কম্পিটিশনে প্রথম পুরস্কার লাভ করে। যুবক বয়সেই তিনি ৮ মিলিমিটার ফিল্মে সহযোগী হিসেবে বিভিন্ন ছবির কাজ শুরু করেন। ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় (১৯৮০-৯০) তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধ শেষে আবার ছবির জগতে ফিরে আসেন এবং ইরানের অন্যতম চলচ্চিত্রকার আববাস কিয়ারসতামির সহযোগী হিসেবে কাজ করেন কিছুদিন। কিয়সতামির পান্ডুলিপি দিয়ে নির্মাণ করেন তার অন্যতম বিখ্যাত ছবি ‘দ্যা হোয়াইট বেলুন’ (১৯৯৫)। যে ছবি কান ফেস্টিভ্যালে শ্রেষ্ঠ চিত্রগ্রহণের জন্য পুরস্কৃত হয়। এরপর একে একে আরো ছবি নির্মাণ করেন। পানাহীকে ইরানের নিও রিয়ালিজমের পথিকৃৎ হিসেবে গণ্য করা হয়। তার ছবি মানবিক আবেদনের জন্য বিশেষভাবে প্রশংসিত। বিশিষ্ট ফিল্ম ক্রিটিক স্টিফেন তেওকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তেও তাকে তার ছবির রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন – ‘‘আমি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নই। রাজনৈতিক ছবি আমার ভালো লাগে না। সামাজিক সমস্যা নিয়েই আমার ছবির বিষয়বস্ত্ত আবর্তিত। বিশেষত সাম্প্রতিক বিষয়সমূহ। আমার কাছে কী কারণে কোন ঘটনা ঘটেছে সেটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। হতে পারে তা রাজনৈতিক বা ভৌগলিক কারণ। আমার কাছে যা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো সামাজিক বিষয়গুলো। আমি কোনো রাজনৈতিক মন্তব্য দিতে চাই না বা কোনো রাজনৈতিক তর্কে জড়াতে চাই না। আমি বিশ্বাস করি একজন শিল্পী রাজনীতির ঊর্ধ্বে নিজেকে নিয়ে যাবে। কারণ রাজনৈতিক ছবির সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সময়ের সীমাবদ্ধতা। সে সময় অতিবাহিত হয়ে গেলে সেই ছবির উদ্দেশ্যও অন্তর্হিত হয়ে যায়। কিন্তু নান্দনিক ছবির কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। সেই ছবি সবসময় সবস্থানে দর্শকের মন ছুঁয়ে যায়। নান্দনিক ছবি কোনো রাজনীতিকে স্পর্শ করে না। তা মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেয় আর আমি নান্দনিক ছবিই নির্মাণ করতে চাই।… একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি শুধু কালো বা শুধু সাদা দেখে। কিন্তু আমি সাদা-কালোকে একত্রে বুনে কাজ করি। আর এখানেই মানবিকতার দৃষ্টি অন্তর্নিহিত।’’
তার ‘দ্য সার্কল’ ছবিটি যখন দেখি, আমরা দেখতে পাই কীভাবে বিভিন্ন নারী ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণী থেকে এসেও একটি নির্দিষ্ট বলয়ে বন্দি হয়ে যায়। একটি নারী শিশুর জন্মের কান্নার ভেতর দিয়ে ছবিটি শুরু হয়, ছবির শেষে একই জেলখানায় সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে আসা নারীদের ঠাঁই হয়। নারীমুক্তির শত শত বাধা সমাজ কীভাবে বেঁধে দিয়েছে সেটা এতো সরল-সহজ ভাষায় পানাহীর মতো আর ক’জনই বা পেরেছে বলতে? ‘হোয়াইট বেলুনে’ও দেখি সেই ছোট্ট মেয়েটি যে কিনা একটা গোল্ডফিস কেনার জন্য কত ধরনের প্রতীকী বিপদের মধ্য দিয়ে পার হয়।
তার অন্যতম ছবি ‘অফ সাইড’ যা নির্মিত হয় ২০০৬ সালে ইরান-বাহরাইন ফুটবল ম্যাচকে কেন্দ্র করে এবং শুটিংয়ের বেশিরভাগ অংশ প্রত্যক্ষ ম্যাচ থেকে ধারণ করা হয়। ছবি শুরুর আগেই পরিচালক আমাদের জানিয়ে দেন – ‘‘ইরানে স্টেডিয়ামের অভ্যন্তরে নারীদের ফুটবল খেলা দেখতে দেওয়া হয় না।’’ ছবির শুরুতেই দেখি পুরুষের পোশাকে একটি মেয়ে বাসে করে স্টেডিয়ামের পথে যাচ্ছে খেলা দেখবে বলে। এই যে নারীর আকুতি ফুটবল খেলা দেখার- তা সে পুরুষের পোশাক পরে হলেও দেখতে চায়। কিন্তু দেখা হয় না, কিন্তু দেখার চেয়েও আরও বড় কিছু পানাহী আমাদের দেখান। যখন স্টেডিয়ামের একটি জায়গায় বেশ কয়েকটা মেয়েকে ধরে রাখা হয় (তারাও ছেলেদের পোশাকে খেলা দেখতে এসেছিল), একটি মেয়ে জিজ্ঞেস করে – ‘‘জাপান বা অন্য দেশের নারীরা যদি খেলা দেখতে পারে তাহলে আমরা কেন পারব না?’’ কোনো উত্তর মেলে না। ছবির একটা বিশেষ মুহূর্তে যখন ইরান গোল দেয়, তখন পুলিশ এবং আটক নারীরা মিলে আনন্দ প্রকাশ করে এই বলে ‘‘লং লিভ ইরান’’ আর এখানেই পানাহীর চরম প্রহসন প্রকাশ পায়। যে দেশে নারীদের খেলা দেখতে দেওয়া হচ্ছে না অথচ দেশের জয়ে উভয়েই (রাষ্ট্র কর্তৃপক্ষ ও আটক ব্যক্তি) আনন্দে উল্লসিত হচ্ছে। শুধু তাই না পানাহীর সব ছবিতে ইরানি সংস্কৃতির উজ্জ্বল উপস্থিতি আমরা লক্ষ্য করি। সেটা কোনো সাপুড়িয়ার খেলার হোয়াইট বেলুন) মাধ্যমে দেখানো হোক বা কোনো স্থানীয় সুরের বাঁশি বাজিয়েই (দ্য সার্কল) শোনানো হোক না কেন।
মানবিকতায় পূর্ণ তার ছবিগুলোকে যখন রাজনীতির কদর্য বেড়াজালে বন্দি করে তার বিরুদ্ধে অযথা অভিযোগ উত্থাপন করা হয় তখন বিশ্বের সিনেমামোদীরা চুপ করে বসে থাকতে পারেন না। তাই চলচ্চিত্র উৎসব থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংস্থা এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। নিউইয়র্ক শাখার এশিয়াটিক সোসাইটির হামিদ দাবাশি পানাহীর সম্পাদিত এবং রাসোলফ পরিচালিত ছবি ‘দ্য হোয়াইট মিডোস’ প্রসঙ্গে বলেন – ‘‘ছবিটি ইরানের দীর্ঘ ঐতিহ্যকে বহন করে। সে ছবি কোনোভাবেই রাজনৈতিক দৃষ্টিতে দেখা উচিত নয়।’’ পানাহী নির্মিত ছবিগুলোকে দাবাশি সিনেমার ইতিহাসের বিভিন্ন আন্দোলনের সঙ্গে তুলনা করে বলেন – ‘‘পানাহীর ছবি ইতালির নিও-রিয়ালিজম, ১৯৭০-এর দশকের জার্মান নিউ ওয়েভ এবং ফ্রান্সের নিউ-ওয়েভের সঙ্গে তুলনীয়। পৃথিবীর বড় মাপের ছবিগুলো সময়োচিত হয় এবং তা সামাজিক ও রাজনৈতিক মানবিক আঘাতরূপে দেখা দেয়। ভালো ছবি শুধু ইরান নয়, পৃথিবীর যে কোনো দেশে তা পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে নির্মিত হয়। দাবাশি সাধারণ মানুষকেও পানাহীর নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে আহবান জানান।
৭ জুন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বিশ্বের সেলিব্রেটিদের নিয়ে নিউইয়র্ক সিটির স্ট্রিট প্লাজার ‘‘আজাদী স্কয়ার’-এ বিক্ষোভ প্রদর্শনের আয়োজন করে। যাদের মাঝে অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্ত নির্মাতা পল হাগিজ থেকে শুরু করে ইরানের অভিনেত্রী ও প্রযোজক ট্রুডি স্টাইলার, সাংবাদিক ও নির্মাতা মাজিয়ার বালানিসহ আরো অনেকে থাকেন। প্রায় বিশ হাজারের অধিক সেলিব্রেটি ও সাধারণ জনগণ নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে পিটিশনে সই করেন। অ্যামনেস্টির কক্স বলেন – ভাবুন তো একবার এমন পরিস্থিতির কথা যখন আপনার সরকার আপনাকে কাজ করতে দিচ্ছে না, আপনি মন খুলে আপনার কথা, আপনার বিশ্বাস বলতে পারছেন না, যদি বলেন তাহলে আপনাকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হচ্ছে। জাফর পানাহী এবং মোহাম্মদ রাসোলফের ক্ষেত্রে যা করা হয়েছে তা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। এর বিরুদ্ধে অবিলম্বে একটা ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন।’’ হাগিজ, যিনি ‘মিলিয়ন ডলার বেবি’ লেখার জন্যে শ্রেষ্ঠ পান্ডুলিপির জন্য পুরস্কৃত, বলেন – ‘‘ ইরানে জাফর পানাহী এবং মোহাম্মদ রাসোলফের ক্ষেত্রে যা করা হয়েছে তা অত্যন্ত অনৈতিক। তাদের বিষয়ে আন্তর্জাতিক সিনেমা মহল চুপ করে থাকতে পারে না। আমাদের অবশ্যই কথা বলতে হবে এবং তাদের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার সব ব্যবস্থা করতে হবে। 
ফ্লোরা সরকার

সোমবার, ১৬ মে, ২০১১

রবীন্দ্র-স্মৃতি - কবি জসীম উদ্দীন

যার ভেতর অনুপ্রেরণা থাকে সেই পারে অপরের প্রেরণা যোগাতে। বড় মনের মানুষেরাই হতে পারে বড় মাপের কবি। তারা নিজেরাও যেমন বড় হয়, অপরকেও বড় হতে সহায়তা করে। আর তাই কবি জসীম উদ্দীনের স্মৃতিকথায় আমরা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বেশকিছু উল্লেখযোগ্য এবং মধুর স্মৃতিচারণ করতে দেখি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫০তম জন্মবার্ষিকীতে সেই মধুর স্মৃতিচারণ থেকে কিছু উল্লেখযোগ্য অংশ সাপ্তাহিক বুধবারের পক্ষ থেকে পেশ করা হলো।
অবনীন্দ্রনাথের দৌহিত্র মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায় আমার বন্ধু। দুইজনে অনেক জল্পনা-কল্পনা করিয়া একদিন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করিতে রওয়ানা হইলাম। তখন বর্ষাকাল। কদমফুলের গুচ্ছ গুচ্ছ তোড়া নানা রকমের ফুলদানিতে সাজানো। আধ-ফোটা মোটা মোটা কেয়াফুলের গুচ্ছগুলি কবির সামনে দুইটি ফুলদানি হইতে গন্ধ ছড়াইতেছিল। বেলিফুলের দু’গাছি মালা কবির পাশে পড়িয়া রহিয়াছে। মনে হইতেছিল, বাংলাদেশের বর্ষা ঋতুর খানিকটা যেন ধরিয়া আনিয়া এই গৃহের মধ্যে জীবন্ত করিয়া রাখা হইয়াছে। চারিধার হইতে সবকিছুই মূক ভাষায় আমার সঙ্গে কথা বলিতেছিল। কবি যদি আমার সঙ্গে কোনো কথাই না বলিতেন, তবু আমি অনুতাপ করিতাম না। সালাম জানাইয়া কম্পিত হস্তে আমি নকশিকাঁথার মাঠ আর রাখালী পুস্তক দুইখানি কবিকে উপহার দিলাম। কবি বই দুইখানি একটু নাড়িয়া-চাড়িয়া আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন, ‘আমার মনে হচ্ছে তুমি বাংলাদেশের চাষী মুসলমানদের বিষয়ে লিখিয়াছ। তোমার বই আমি পড়িব’।

প্রথম পরিচয়ের উত্তেজনায় সেদিন কবির সঙ্গে আর কি কি আলাপ হইয়াছিল, আজ ভালো করিয়া মনে নাই। ইহার দুই-তিনদিন দীনেশচন্দ্র সেন মহাশয়ের মাধ্যম ছেলে অধ্যাপক অরুণ সেন আমাকে ডাকিয়া বলিলেন, ‘তুমি কবিকে বই দিয়ে এসেছিলে। আজ দুপুরে আমাদের  সামনে কবি অনেকক্ষণ ধরে তোমার কবিতার প্রশংসা করলেন। এমন উচ্ছ্বসিতভাবে প্রকাশ করেছেন, তিনি তোমাকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে যাবেন।’

পরদিন সকালে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে আসিয়া আমি কবির সঙ্গে দেখা করিলাম। কবি আমার বই দুইখানির প্রশংসা করিলেন। বলিলেন, ‘আমি শান্তিনিকেতনে গিয়েই তোমার বই দুইখানার উপর বিস্তৃত সমালোচনা লিখে পাঠাব। তুমি শান্তিনিকেতনে এসে থাকো। ওখানে আমি তোমার একটা বন্দোবস্ত করে দেব।’ আমি বিনীতভাবে উত্তর করিলাম, ‘এখানে আমি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ পড়ছি। শান্তিনিকেতনে গেলে তো পড়া হবে না।’

কবি বলিলেন, ‘ওখান থেকে ইচ্ছে করলে তুমি প্রাইভেট এমএ পরীক্ষা দিতে পারবে। আমি সে বন্দোবস্ত করে দেব।’ আমি উত্তরে বলিলাম, ‘ভালো করে ভেবে দেখে আমি আপনাকে পরে জানাব।’

কলকাতায় আমার সবচাইতে আপনজন ড. দীনেশচন্দ্র সেন মহাশয়ের সঙ্গে এ বিষয়ে পরামর্শ করিলাম। তিনি আমাকে কলিকাতা ছাড়িয়া শান্তিনিকেতনে যাইতে নিষেধ করিলেন। তিনি বলিলেন, ‘কবি যদি এত বৃদ্ধ না হতেন তবে আমি তোমাকে ওখানে যেতে বলতাম। কিন্তু কবি কতকাল বেঁচে থাকবেন, বলা যায় না। এখান থেকে এমএ পাস করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করো। ওখানকার আশ্রয় বহুদিন পাওয়ার সৌভাগ্য তোমার না-ও হতে পারে।’ আমার আর শান্তিনিকেতনে যাওয়া হইল না।

প্রায় দুই মাস হইয়া গেল। কবি আমার বই-এর সমালোচনা পাঠাইলেন না। মোহনলালকে দিয়া কবিকে পত্র পাঠাইলাম। কবি একটা ছোট্ট চিঠিতে মোহনলালকে লিখিয়া পাঠাইলেন, ‘জসীম উদ্দীনের কবিতার ভাব, ভাষা ও রস সম্পূর্ণ নতুন ধরনের। প্রকৃত কবির হৃদয় এই লেখকের আছে। অতি সহজে যাদের লেখবার শক্তি নেই, এমনতর খাঁটি জিনিস তারা লিখতে পারে না।’ কবির এই কথাগুলি নকশিকাঁথার মাঠে ছাপা হইলে বাংলাদেশের বহু সাহিত্যিক ইহার প্রশংসা করিয়াছিলেন। যাঁহারা বিরুদ্ধ সমালোচনা করিতে প্রস্ত্তত হইতেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের এই প্রশংসার পরে তাঁহারা আর সে বিষয়ে সাহসী হইলেন না।

ইহার পর রবীন্দ্রনাথ যখনই কলিকাতা আসিয়াছেন, আমি অবসর পাইলেই গিয়া দেখা করিয়াছি। আমাকে দেখিলেই কবি তাঁর বিগতকালের পদ্মাচরের জীবন লইয়া আলোচনা করিতেন। তখন আমি বালুচর বইয়ের কবিতাগুলি লিখিতেছি। ইহার অধিকাংশ কবিতাই ত্রিপদী ছন্দে লিখিত। মাসিকপত্রে ইহার অধিকাংশ কবিতা ছাপা হয়। সমালোচকেরা বলিতে লাগিলেন, ‘তোমার কবিতা একঘেয়ে হইয়া যাইতেছে। ছন্দ পরিবর্তন করো।’

একদিন কবিকে এই কথা বলিলাম। কবি বলিলেন, ‘ওসব বাজে লোকের কথা শুনো না। যে ছন্দ সহজে এসে তোমার লেখায় ধরা দেয়, তাই ব্যবহার করো। ইচ্ছে করে নানা ছন্দ ব্যবহার করলে তোমার লেখা হবে তোতাপাখির বোলের মতো। তাতে কোনো প্রাণের স্পর্শ থাকবে না।’

রাজরানী নাটকখানি নতুন করিয়া লিখিয়া রবীন্দ্রনাথ ইহার তপতী নামকরণ করিলেন। এই নাটক মহাসমারোহে কবি কলিকাতায় অভিনয় করিলেন। এই অভিনয়ে কবি রাজার ভূমিকা গ্রহণ করিয়াছিলেন। সত্তর বৎসর বয়সের বৃদ্ধ কি করিয়া প্রেমের অভিনয় করিবেন, তাঁহার শাদা দাড়িরই বা কি হইবে, অভিনয়ের পূর্বে এইসব ভাবিয়া কিছুই কূল- কিনারা পাইলাম না। কিন্তু অভিনয়ের সময় দেখা গেল দাড়িতে কালো রং মাখাইয়া মুখের দুই পাশে গালপাট্টা তুলিয়া দিয়া কবি এক তরুণ যুবকের বেশে মঞ্চে আসিয়া দাঁড়াইলেন। তপতী নাটকে রাজার ব্যর্থ প্রেমের সেই মর্মান্তিক হাহাকার কবির কণ্ঠমাধুর্যে আর আন্তরিক অভিনয় নৈপুণ্যে মঞ্চের উপর জীবন্ত হইয়া উঠিয়াছিল।

রবীন্দ্রনাথের কবিতার খাতা দেখিয়াছি। তাহাতে এই পরিবর্তন ও এত কাটাকুটি যে দেখিয়া অবাক হইতে হয়। রবীন্দ্রনাথের সৃজনীশক্তি কিছু করিয়া তৃপ্ত হইতে জানিত না। তিনি আজীবন এতো গ্রন্থ রচনা করিয়াছেন। তাহার প্রত্যেকখানিতে তাঁহার মনের একান্ত যত্নের ছাপ লাগিয়া রহিয়াছে। গ্রন্থগুলি লিখিয়া অধিকাংশ ক্ষেত্রে তিনি অপরকে দিয়া নকল করান নাই। যতবার নকল করিতে হয় নিজেই করিয়াছেন এবং  প্রত্যেকবারেই সেই রচনার ভিতর তাঁহার সৃজনীশক্তির অপূর্ব কারুকার্য রাখিয়া গিয়াছেন।

তপতীর পরেও নাটক রচনার নেশা রবীন্দ্রনাথকে পাইয়া বসিয়াছিল। তাঁহার সঙ্গে দেখা করিতে একদিন আমি পাড়াগাঁয়ের লোকনাট্য, আসমান সিংহের পালার উল্লেখ করিলাম। কথা প্রসঙ্গে কবি আমাকে বলিলেন, ‘তুমি লেখো না একটা গ্রাম্য নাটক।’ আমি বলিলাম, ‘নাটক আমি একটা লিখেছি। কিন্তু অবনীন্দ্রনাথ পড়ে বলিলেন, নাটক লেখার শক্তি তোমার নেই।’ কবি একটু জোরের সঙ্গে উত্তর করিলেন, ‘অবন নাটকের কি বোঝে? তুমি লেখো একটা নাটক তোমাদের গ্রাম দেশের কাহিনী নিয়ে। আমি শান্তিনিকেতনের ছেলে-মেয়েদের দিয়ে অভিনয় করিয়ে দেবো।’ আমি বলিলাম, ‘একটা প্লট যদি দেন তবে আর-একবার চেষ্টা করে দেখি।’ কবি বলিলেন, ‘আজ নয়, কাল সকালে এসো।’ কবির এই প্লট অবলম্বন করিয়া আমি নাটক রচনা করিয়াছিলাম। দুই- তিনবার অদলবদল না করিয়া কিছুতেই কোনো লেখা আমি প্রকাশ করি না। তাই কবি জীবিত থাকিতে তাঁহাকে এই নাটক দেখাইতে পারি নাই। পল্লীবধূ নাম দিয়া এই নাটক কয়েক বৎসর পূর্বে প্রকাশিত হইয়াছে। ঢাকা বেতারে এই নাটক অভিনীত হইয়া শত শত শ্রোতার মনোরঞ্জন করিয়াছে। আজ যদি রবীন্দ্রনাথ বাঁচিয়া থাকিতেন, তাঁহাকে এই নাটক উপহার দিয়া মনে মনে কতই না আনন্দ পাইতাম।